ব্রেকিং

x

‘ঘরে শিশু’ ‘গর্ভে সন্তান’ তবুও বিরামহীন তারা

শনিবার, ০৯ মে ২০২০ | ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ

‘ঘরে শিশু’ ‘গর্ভে সন্তান’ তবুও বিরামহীন তারা

‘ঘর থেকে একরকম চোরের মতো বের হয়ে পড়ি। কখন না আবার ছোট ছেলেটা (দুই বছর বয়স) পিছু নেয়। রাতে এসেও কোলে নিতে পারি না। ফেরার পর একটু ভালোভাবে ফ্রেশ হতে হতে হয়তো ছেলেটা ঘুমিয়ে যায়।’ বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমা আশরাফী।


জেলার কসবা উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) হাসিবা খানের মেয়ে আনাবিয়া-নূর এর বয়স সাড়ে সাত মাস। মা ঘরে এলেই ছুটে এসে কোলে উঠতে চায় ছোট্ট ওই শিশু। কিন্তু নিজেকে ভালোভাবে জীবাণুমুক্ত না করে কোলে না নিতে পারার যন্ত্রণা হয়তো তাড়া করে বেড়ায় দুজনকেই।


নাজমা আশরাফী, হাসিবা খানরা করোনাযোদ্ধা। তাঁদেরই সহকর্মী মেহের নিগার, যিনি বিজয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ওই নারী সন্তানসম্ভবা। কিন্তু থেমে থাকার সুযোগ নেই। করোনা পরিস্থিতিতে ছুটে চলতে হচ্ছে দিনরাত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৯ উপজেলায় ইউএনও হিসেবে তিনজন ও এসিল্যান্ড হিসেবে পাঁচজন কর্মরত আছেন। এর মধ্যে নাসিরনগর উপজেলাতে ইউএনও ও এসিল্যান্ড এই দুই পদেই নারী কর্মরত। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন থাকা বিজয়নগর উপজেলা ও জেলার করোনার ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত আখাউড়া উপজেলাও সামাল দিচ্ছে নারী ইউএনও। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁরা ছুটে চলছেন দিনরাত। ঘরে এবং গর্ভে সন্তান নিয়েই তাঁদের অবিরাম ছুটে চলা। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েই তাঁরা কাজ করে চলছেন।

ওই আটজনের সঙ্গে কথা হলে প্রত্যেকেই দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। জানালেন, দায়িত্ববোধ থেকেই নির্ধারিত কাজের বাইরেও অনেক কিছু করে যাচ্ছেন জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে। ভালো একটা দিনের প্রত্যাশায় আছেন তাঁরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌলা খাঁন সার্বিক পরিস্থিতিতে নারী কর্মকর্তাদের কাজের প্রশংসা করেছেন। শুক্রবার দুপুরে কথা হলে তিনি বলেন, এটা আমার জন্য গর্বের যে তাঁরা যোগ্যতার পরিচয় রেখে দায়িত্বশীলতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ যাচ্ছেন। ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, মোবাইল কোর্ট পরিচানলা, বাজার মনিটরিংসহ সব কাজই সর্বোচ্চ পরিশ্রমের সঙ্গে করে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায় ছাড়াও জেলা পর্যায়ে কর্মরত নারী কর্মকর্তা এডিএম মিতু মরিয়ম, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুনু সাহা, তনিমা আফ্রাদ, সাফফাত আরা সাইদ করোনা পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাজেই সবাই খুশি।

সকাল সোয়া ১১টায় কথা বলার সময় কার্যালয়ের বাইরে ছিলেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা। জানালেন, করোনাসংক্রান্ত কাজেই বের হয়েছেন। এখন আর সময় মেনটেইন করে কিছু করা যায় না। সাতসকালে যেমন বের হতে হয় তেমনি ফিরতে অনেক রাত হয়। কোয়ারেন্টিন মেনে আইনজীবী স্বামী আখাউড়ার বাসভবনে থাকায় ছোট ছেলে তাহমিনুল ইসলামকে সামলাতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছে না।

সন্ধ্যায় কথা হয় বিজয়নগরের ইউএনও মেহের নিগারের সঙ্গে। ছয় বছরের ছেলে সন্তানের জননী মেহের নিগার এখন সন্তানসম্ভবা। পরিস্থিতি কিভাবে সামলান জানতে চাইলে বলেন, প্রশিক্ষণের জন্য আমাদেরকে যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে দেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এই মুহূর্তে আমি চাইলে ছুটি নিতে পারতাম। তাহলে আমি বিবেকের কাছে হেরে যেতাম। আবার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর কাছ থেকেই কাজের স্পৃহা পেয়েছি।

আশুগঞ্জের এসিল্যান্ড ফিরোজা পারভীনের স্বামীও একজন করোনাযোদ্ধা। লন্ডনে তিনি চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। পঞ্চম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে ও ১৪ মাসের ছেলে সন্তানের জননী ফিরোজা পারভীন বলেন, এখন তো পরিবারের চিন্তা করলে হবে না। মহামারির এই সময়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। সব কিছুতেই এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

সরাইলের এসিল্যান্ডের দায়িত্ব পালন করা ফারজানা প্রিয়াঙ্কা বলেন, দায়িত্ব পালনে নারী পুরুষ বলতে কোনো কথা নেই। জেলা প্রশাসক মহোদয় যেভাবে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন সেভাবেই কাজ করে যাচ্ছি। যতটুকু সতর্ক থেকে কাজ করা যায় সেটা মেনটেইন করছি।

নাফিসা নাজ নীরার একমাত্র কন্যা সন্তান নাবিহা নাওয়ার এর বয়স এক বছর ১০ দিন। ছোট্ট এই শিশুটিকে ঘরে রেখেই ছুটতে হয় জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় কর্মরত এসিলান্ড নাফিসা নাজকে। তিনি বলেন, দায়িত্ব ভেবেই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। স্বামী সঙ্গে আছেন বলে বেশ সাপোর্ট পাচ্ছি সংসারের দিক থেকে।

কসবায় কর্মরত এসিল্যান্ড হাসিবা খান অবশ্য এই সময়ে স্বামীর সাপোর্টটা পাচ্ছেন না। পুলিশে কর্মরত বিধায় তিনি আছেন নিজ দায়িত্বে। হাসিবা খান বলেন, সাড়ে সাত মাস বয়সী মেয়ে আনাবিয়া-নূর কে সামলাতে ভার্সিটিপড়ুয়া আমার ছোট বোন ইসরাত জাহানকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এমনও হয়েছে যে কাজের মধ্যেই খবর পেলাম মেয়েটা কাঁদছে তখন ছুটে আসতে হয়। আবার কখনো তাৎক্ষণিক ছুটে আসাও সম্ভব হয় না। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নের কথা মাথায় রেখে এভাবেই মানিয়ে চলছি।

কথা হয় পাঁচ বছরের ছেলে ও দেড় বছরের মেয়ে সন্তানের মা নাসিরনগরের এসিল্যান্ড তাহমিনা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে ভয় আছে। কিন্তু দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। এখন অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ঘরে এলে ছেলে-মেয়েরাই বলে যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি ঠিক রাখি।

আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!