ব্রেকিং

x

বাংলাদেশ সফরে কক্সবাজার ভ্রমন অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশ সফরে কক্সবাজার ভ্রমন অভিজ্ঞতা
সূর্যাস্তের সময় কক্সবাজার। সব ছবি তুলেছেন রাখি বিশ্বাস

বাংলাদেশ সফর-(এক)
বাংলাদেশের প্রতি বরাবরই একটা টান অনুভব করি। বাংলাদেশের মাটির ঘ্রাণ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি সবকিছুই খুব কাছে টানে। এর আগে বাংলাদেশ সফর বলতে একবেলার জন্যে রামগড় যাওয়া, তাও সরকারি সফর। সেটা সাব্রুমের মহকুমা শাসক থাকার সময়ে মৈত্রী সেতুর প্রারম্ভিক সার্ভের জন্যে একটা যৌথ টিমের সদস্য হিসাবে গেছিলাম। তারপর কেটে গেছে অনেক অনেক বছর। যাবো যাচ্ছি করতে করতে একবার পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়েছে। আবার নবীকরণ করার পরে স্থির করেই নিয়েছিলাম যে এবারে যাবোই। সেই মতোই সব ফর্মালিটি শেষ করে ২৪ তারিখ সন্ধ্যায় পা রাখলাম বাংলাদেশের মাটিতে। আখাউড়াতে আমাদের রিসিভ করতে অপেক্ষা করছিলেন নুরুন্নবী ভাই, আমার অনেক দিনের বন্ধু। প্রথমে আমরা গিয়ে উঠলাম নবী ভাইয়ের বাসায়। সেখান থেকে রাতে আমাদের ট্রেন ধরে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা। কিন্তু পৌঁছেই শুনলাম ট্রেন২ ঘণ্টা লেট। সেজন্যে রাত ১২ টায় যে ট্রেন যাওয়ার কথা, সেটাই যাবে রাত দুটোর সময়। অতএব আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। নবী ভাইয়ের বাসায় চা জলখাবার খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম আখাউড়া রেকি করতে। প্রথমেই দেখলাম রানীর দীঘি আর রাজার দীঘি। তৎকালীন ত্রিপুরার রাজার তৈরি দুটো দীঘি যা ত্রিপুরা রাজার অধীনস্থ ছিলো স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত। স্বাধীনতার পরে যখন দেশ ভাগ হয়ে যায়, তখনকার ত্রিপুরার রাজা সেগুলো প্রজাকে স্থায়ী লিজ দিয়ে স্বত্ত ত্যাগ করেন। দীঘির অনেকটা অংশই বুজিয়ে সেখানে অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে। বর্তমানে এর অনেক মালিক। এরপর আমরা গেলাম ’রাধামাধব আখড়া’ মন্দিরে। সেদিন দশমী ছিলো, কিন্তু আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পূর্বেই বিসর্জন হয়ে গেলো। কিন্তু মন্দিরে দেখলাম খুব ভীড়, বিশেষ করে নারীরা সিঁদুর খেলার পরে ওখানেই বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো। মন্দিরের পুরোহিত এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন নবী ভাই। কথা বলে ভালো লাগলো। আখাউড়া অঞ্চলটি মূলত হিন্দু অধ্যুষিত। কিন্তু এখানে মুসলিম পরিবারও অনেক রয়েছে। এখানে হিন্দু মুসলিম একত্রিত হয়েই থাকেন, একজনের উৎসবে আরেকজনের উপস্থিতি থাকে। রাধামাধব আখড়া মন্দিরের পুরোহিত আমাদের নবী ভাইয়ের মামা হোন। ছোটবেলায় এই মন্দির প্রাঙ্গণে হেসে খেলে বড় হয়েছেন নবী ভাইয়েরা। এরপর আমরা স্টেশন দেখতে গেলাম। কক্সবাজারের সঙ্গে ট্রেনে সরাসরি সংযোগ হবে এর মধ্যেই। তারই জোর প্রস্তুতি চলছে। শেষে বাজার ঘুরে, ডাবের জল খেয়ে (ওখানে ডাবের অনেক দাম) আমরা আবার ফিরলাম নবী ভাইয়ের বাসায়। ফেরার সময় নবী ভাইয়ের দাদা বাদল ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হলো। ওনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জজ কোর্টে সরকারি উকিল (এপিপি) হিসাবে কাজ করেন, সেই সঙ্গে এলাকার একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সেদিন ছুটি থাকায় বাড়ি এসেছেন। আমরা এসেছি শুনে যারপরনাই আনন্দিত। আমাদের রাতের খাবারের আগেই বাদল ভাইয়া চলে এলেন আড্ডা দিতে। আমরা একসঙ্গে রাতের খাবার খেলাম। খাবারের বর্ণনা আর দিতে গেলাম না। বাংলাদেশের আতিথ্য পৃথিবীখ্যাত, তাই ম্যেনু তে কিছুই বাদ পড়লো না। আমাদের যেহেতু ট্রেন ডিলে হয়ে গেছিলো, সেজন্যে খাওয়ার পরে আমাদের আড্ডা জমে গেলো। বাদল ভাইয়া এই আড্ডার সবচেয়ে উৎসাহী মানুষ। আমরা কক্সবাজার যাচ্ছি শুনে অনেকরকম পরামর্শও দিলেন। আড্ডা’র ফাঁকে একসময় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ঝমঝমিয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলো। এরপর আড্ডা দিতে দিতে কখন যে ট্রেনের সময় হয়ে গেলো বুঝতেই পারিনি। নবী ভাই দুটো টোটো ডেকে আনলেন। আমাদের যাতে ট্রেনে সফর করতে কোন রকম অসুবিধা না হয় এবং যাতে চট্টগ্রাম থেকে আমরা ইজিলি বাস ধরতে পারি, সেজন্যে একজন ভাইকে আমাদের সঙ্গী করে দিলেন। আমরা যথারীতি ট্রেনে উঠে গেলাম। আমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে নবী বিদায় নিলেন। আমাদেরও যাত্রা শুরু হয়ে গেলো। ট্রেনের নাম মহানগর এক্সপ্রেস, আমাদের কামরার নাম স্নিগ্ধা, বগি ‘ চ ‘। ট্রেন ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ট্রেনে উঠেই যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।

বাংলাদেশ সফর-(দুই)
কক্সবাজার ভ্রমন-১
সকালে একদম সময় মতো ট্রেন পৌঁছে গেলো চট্টগ্রাম। তখন সকাল ৬ টা। ঠিক চার ঘণ্টা সময়ে আখাউড়া থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে গেছি। লাগেজ সংগ্রহ করে, স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের সঙ্গে যে ভাই এসেছেন, ওনি বললেন যে স্টেশন এর বাইরেই বাস পাবো। সেরকমই দেখলাম যে বাস দাঁড়িয়ে আছে কক্সবাজারের। দেরী না করে টিকেট কেটে উঠে পড়লাম বাসে। ভাই সেখান থেকে বিদায় নিলো, ওনি আবার ফিরতি ট্রেন ধরবেন। সবারই একটু খিদে পাচ্ছিলো। সেজন্যে কলা, বিস্কুট আর বন রুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে যার যার সিটে বসে পড়লাম। নির্দিষ্ট সময়েই বাস ছেড়ে দিলো। বাইরে তখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি, জানালার কাঁচের বাইরে আবছায়া। পথে দেখতে পেলাম চট্টগ্রাম পোর্টে সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। আগের রাতে যেহেতু ভালো ঘুম হয়নি, সেজন্যে আধো ঘুম, আধো জাগরণে কেটে গেলো আমাদের যাত্রা পথ। উপভোগ করতে করতে গেলাম অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। যখন কক্সবাজার পৌঁছুলাম, তখন সকাল ১১টা। বৃষ্টি নেই, ঝকঝকে আকাশ। টোটো ভাড়া করে হোটেলে পৌঁছুলাম। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম আগের দিন ভয়ানক ঝড় বয়ে গেছে কক্সবাজারের উপর দিয়ে। ফলে বিদ্যুৎ নেই, জেনারেটরে সব চলছে। এমনকি মোবাইলের টাওয়ার, wi fi কিছুই কাজ করছে না। আমরা রুমে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে একটু হালকা টিফিন করে খানিকটা সময় রেস্ট নিলাম। তারপর হোটেলে লাঞ্চ করলাম বাংলাদেশের বিখ্যাত চিকেন খিচুড়ি, কোরাল ফিশ ভর্তা আর ডাল দিয়ে। বাংলাদেশের খাবারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিভিন্নরকম এর ভর্তা, তারই একটা ট্রাই করলাম প্রথমদিন। অসাধারণ লাগলো। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে রোদ একটু কমতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রের দিকে। আমাদের হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই একটা বীচ রয়েছে, নাম সুগন্ধা বীচ। পায়ে হেঁটেই গেলাম।

যাওয়ার পথে সারি সারি দোকান বসে আছে নানারকমের পসরা সাজিয়ে। বেশিরভাগই ঝিনুকের তৈরি নানারকম সামগ্রী। দেখলাম আমাদের দেশের গুজরাটি কাজ করা ব্যাগও সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। আর পাওয়া যাচ্ছে বার্মিজ নানারকম জিনিস। যখন আমরা বীচে পৌঁছুলাম, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। অনবদ্য একটা মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইলাম। বীচে আমরা বেশ কিছুক্ষণ ধার বরাবর হাঁটলাম। সে এক অন্যরকমের অনুভূতি। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে এলো। যেহেতু ওইসময় শুক্ল পক্ষ ছিলো, সন্ধ্যার বীচ ও অপরূপ। সেইসঙ্গে সমুদ্রের গর্জন এক অপরূপ মূর্ছনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। ধীরে ধীরে ঘোর কাটিয়ে আমরা বীচ ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। ঝাল মুড়ি বাদাম ইত্যাদি অনেক কিছু বিক্রি হচ্ছিলো, কিন্তু আমাদের দীঘা’র মতো মাছ ভাজা কোথাও খুঁজে পেলাম না গোটা বীচ চত্বর জুড়ে। বীচ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও দেখলাম হাতে বিস্তর সময় রয়েছে। তখন ঠিক হলো একটা টোটো নিয়ে পুরো শহরটা ঘুরে দেখার। সেই মতো একটা টোটো ভাড়া করা হলো। মিষ্টভাষী একটা ছেলে, খুব ভদ্র ব্যবহার। ছেলেটির নাম আমিনুল। সে আমাদের পুরো শহর, শহরের বিভিন্ন বীচ গুলো ঘুরে দেখালো। বাংলাদেশের একটা প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকানের নাম ফুলকলি। এদের ব্রাঞ্চ রয়েছে সারা বাংলাদেশ জুড়ে, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার আসার পথেও বেশ কয়েকটি দোকান দেখেছিলাম। তারই একটা শাখায় আমাদের নিয়ে গেলো আমিনুল। থরে থরে সাজানো মিষ্টি দেখে লোভ জাগাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ওখানে মিষ্টির সাংঘাতিক দাম।আমাদের এখানকার তুলনায় প্রায় চার গুণ।আমরা অল্প কিছু খেলাম আর কিছুটা প্যাক করিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। এরপর আরো কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। আমিনুলের সঙ্গে কথা হলো পরদিন সে আমাদের সারাদিন পুরো কক্সবাজার ঘোরাবে। রাতে আমাদের ম্যেনুতে ছিলো সাদা ভাত, আলু ভর্তা, ডাল ফ্রাই আর লইট্যা মাছের তরকারি। আলু ভর্তাও যে এত সুস্বাদু হতে পারে, ধারণাই ছিল না। যেহেতু আগের রাতে আমাদের ঠিকঠাক মতো বিশ্রাম হয়নি, তাই আমরা সবাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

বাংলাদেশ সফর (তিন)
কক্সবাজার ভ্রমন-২
কক্সবাজারের দ্বিতীয় দিন আমরা সকাল সকাল হোটেলে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমিনুলের টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য মেরিন ড্রাইভ। কক্সবাজার থেকে এটা প্রায় ৪৫/৫০ মিনিট লাগে। যেতে যেতে রাস্তার একপাশে সমুদ্র, আরেকদিন সুদৃশ্য হোটেল রেস্তোরাঁ। কিছু বাড়িঘর, অফিসও রয়েছে। মেরিন ড্রাইভের এই রাস্তাটা সোজা টেকনাফ গিয়ে শেষ হয়েছে। আগে রাস্তাটা এত ভালো ছিল না, তখন সমুদ্রের পাড় ধরে যেতে হতো। আমাদের প্রথম বিরতি হলো হিমছড়িতে। সেখানে একটা ঝরনা রয়েছে আর পাহাড়। ঝরনার যাওয়ার পথে সারি সারি দোকানে নানারকমের পশরা। ঝরনাতে খুব বেশি জল নেই, তবুও ভালোই লাগলো। আমরা দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। পাহাড়টায় আর কেউ উঠে না, ওটায় সতর্কবার্তা দেওয়া আছে। ফেরার পথে আমরা টুকটাক জিনিস কিনলাম, বিশেষ করে উপহার সামগ্রী। ওখানে বার্মিজ আচার আর চাটনিও পাওয়া যাচ্ছিলো। সেগুলোও কেনা হলো অনেকটা। তারপরে আবার আমাদের পথ চলা শুরু হলো। মেরিন ড্রাইভের শেষ বীচে যখন পৌঁছুলাম, তখন অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সেখানে পৌঁছে, একটা দোকানে আগে চা খেলাম। আমাদের যেহেতু ঘনঘন চা খাওয়ার অভ্যাস, তাই একটু পরে পরেই চায়ের তেষ্টা পায়। চা শেষ করে বীচে পৌঁছুতেই দেখলাম মোটর সাইকেল ভটভটি পাওয়া যাচ্ছে। ওরা বললো সমুদ্রে সৈকত ধরে ঘুরিয়ে আনবে। অনেক দূরে লাল কাঁকড়া আছে, সেগুলো দেখিয়ে আনবে। একটা ভটভটিতে দুজন করে বসা যায়। আমরা ছয়জন রয়েছি, তাই আমাদের ৩টা ভটভটি লাগবে। অনেক দাম দর করে তিনটা ভটভটি ঠিক করা হলো। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এই চলা মন্দ লাগলো না।

একটা জায়গাতে অনেক লাল কাঁকড়াও দেখলাম। ফিরে এসে ওরা একটা পাথুরে জায়গায় নামিয়ে দিলো। পাথর পেরিয়ে আমরা সমুদ্রে নামলাম। সমুদ্রের ঢেউ পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছিল। অনেক ছবি তোলা হলো বিভিন্ন পোজে। পাথরের উপরে বসে আমরা ফল আর মিষ্টি খেলাম। তারপর আবার ফেরার পথ ধরলাম। আমিনুল আমাদের জন্যে রাস্তার উপরে অপেক্ষা করছিলো। সেখান থেকে আরো কিছুটা এগিয়ে আরো একটা বীচ পেলাম। একটা বাঁশের সাঁকো পেরোতে হয়। তারপরে দুধারে ঝাউয়ের বন। ঝাউবন পেরিয়ে বীচে পৌঁছানো গেলো। অনেক শান্তশিষ্ট একটা বীচ। তখন ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে, ফলে সমুদ্র পিছিয়ে গেছে। সেখানেও বেশ খানিকটা সময় ঘুরাঘুরি করে আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। ততক্ষণে আমাদের আবার চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেছে। তাই আমিনুলকে বললাম কোথাও একটা দাঁড়াতে। কিন্তু ওখানে বেশিরভাগ রেস্তোরাঁ চা কফি দিতে পারবে না জানালো, কেননা ওরা সবাই মেশিনে চা কফি বানায় আর বিদ্যুৎ না থাকায়, ওদের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। এখানে উল্লেখ করে রাখি, ২৪ তারিখের ভয়াবহ ঝড়ের পরে এতোটাই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল যে তৃতীয় দিনেও বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি। অবশেষে টি এন্ড কফি নামে একটা রেস্তোরাঁয় চা আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পাওয়া গেলো। কিন্তু ১০ টাকার চা, ৭০ টাকায় খেতে হলো। তখন বিকাল চারটা বেজে গেছে। আমিনুল আমাদের বললো যে ওকে টোটো রিচার্জ করতে হবে। সেজন্যে সে রেডিয়েন্ট ফিশ ওয়ার্ল্ড ( সাগর তলের রহস্য) এ আমাদের নামিয়ে দেবে। সেখানে আমাদের দুই/ আড়াই ঘণ্টা লাগবে। শেষ হলে আবার আমাদের নিয়ে আসবে। ততক্ষণে ওর টোটো রিচার্জও হয়ে যাবে। টিকেট কেটে আমরা ভেতরে ঢুকে পড়লাম। অসাধারণ লাগলো। মনে হলো সমুদ্রের তলদেশ এ রয়েছি। নানারকমের মাছ, সামুদ্রিক প্রাণীর সমাহার। এছাড়াও রয়েছে আলাদা আলাদা প্রজাতির মাছের জন্যে আলাদা আলাদা অ্যাকুয়ারিয়াম। সে এক অন্য জগৎ। ওখানে থ্রি ডি মুভিরও ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেটা কেউ দেখতে চাইলো না। ঘুরে ঘুরে চলে এলাম ফিশ ফুট থেরাপির ওখানে। জলে পা ডুবিয়ে বসতে হবে, মাছ এসে পায়ে ঠোকরায়। আমরা তিনজন বসে গেলাম, বাকি তিনজন রাজি হলো না। প্রায় ২০ মিনিট সময়। ছোটছোট মাছ এসে পায়ে ঠোকরায়, ফলে সুড়সুড়ি লাগে, বেশ আরাম, রিলাক্সও হয়ে গেলাম। আমাদের সময়ও শেষ হয়ে এলো। সারাদিন ঘুরাঘুরি করতে করতে প্রপারলি আমাদের লাঞ্চ করা হয়নি। তখন সন্ধ্যা সাতটা। ফিশ ওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়েই একটা ছোট রেস্তোরাঁয় আমরা টিফিন খেলাম, ওরাও বিদ্যুৎ নেই বলে চা খাওয়াতে পারলো না। ততক্ষণে আমিনুল টোটো নিয়ে চলে এসেছে। যখন হোটেলে পৌঁছুলাম, ততক্ষণে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাতে আমাদের ডিনারে ম্যেনু ছিলো চাইনিজ। পরেরদিন মহেশখালী যাওয়ার কথা ভেবে নিয়ে যে যে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়লাম।

বাংলাদেশ সফর (চার)
কক্সবাজার ভ্রমন-৩
কক্সবাজারে আজকে ছিলো আমাদের লাস্ট ডে। আমরা সকালে খাওয়া দাওয়া করে রওনা দিলাম মহেশখালীর দিকে। হোটেলের সামনে থেকেই একটা টোটো নিলাম। সেটা আমাদের ঘাট পর্যন্ত নিয়ে গেলো। ঘাটে গিয়ে দেখলাম অনেক স্পীড বোট রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে দেশী নৌকা আকারে একটু বড়। স্পীড বোটে যেতে ১৫/২০ মিনিট লাগে আর দেশী নৌকায় গেলে ১ঘণ্টা। এগুলোর নির্দিষ্ট কোনো ভাড়া নেই। অনেক দরদাম করে আমরা একটা স্পীড বোট ঠিক করলাম। আমাদের নিয়ে আদিনাথ মন্দিরের ঘাটে যাবে, আবার আমরা ঘুরে এলে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। জলে আমার বরাবরই ভয়। তাই স্পীড বোট যখন চলতে শুরু করেছে, তখন ভয় জাঁকিয়ে ধরেছে। শক্ত করে ধরে বসে আছি। বোট ঢেউ এর সঙ্গে সঙ্গে দোলে উঠছে, সে আরো ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু কিছুদূর যেতে যেতে এটা স্বাভাবিক হয়ে এলো। আপনা থেকেই কখন ভয়টা কেটে গেছে বুঝতেই পারিনি। একটা সময় ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ছবি তুলতে শুরু করেছি। চারিদিকে জলের অপার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম। ঘাটে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে একটা প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখান থেকে সরু একটা ব্রীজ চলে গেছে। দুপাশে ম্যানগ্রোভ এর জঙ্গল। অপরূপ সবুজের সমারোহ। সেখান থেকে আমরা একটা টোটো ভাড়া করলাম। কথা হলো সে আমাদের সবগুলো স্পট ঘুরিয়ে দেখাবে, তারপর আবার ঘাটে এনে নামিয়ে দেবে। প্রথমেই আমরা গেলাম বৌদ্ধ মন্দির। ১৯৪৭ সালের আগে এই মন্দির তৈরী হয়েছে। কে বা কারা করেছে জানা গেলো না। তবে পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনা করলে ধারণা করা যায়, বার্মিজরাই এই বৌদ্ধ মন্দির তৈরী করেছে এবং আশেপাশে অনেক বার্মিজ লোকেরা রয়েছেন, এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। অনেক গুলো ছোট ছোট মন্দির রয়েছে একটা বিস্তৃত জায়গা জুড়ে। কিছু কিছু মন্দিরের পুনঃনির্মাণ চলছে। আবার নতুন মন্দিরের কাজও হচ্ছে। প্রত্যেকটা মন্দিরে বুদ্ধের আলাদা আলাদা পোজের মূর্তি। সবমিলিয়ে খুব দারুণ একটা জায়গা। মন্দিরের বাইরে ছোট ছোট দোকানে কাপড়জামা বিক্রি হচ্ছে। একটা ছোট চায়ের দোকানে আমরা চা খেয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম। একটা শুটকি পট্টি। সারি সারি শুটকি মাছের দোকান। আবার সামনেই মাঠে শুটকি শুকাতে দেওয়া হয়েছে।

জায়গাটা বেশ অপরিচ্ছন্ন। পাশেই আরেকটা ছোট আকারের বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে, কিন্তু গেটে তালা দেওয়া, প্রবেশ নিষেধ। ২৪ তারিখের ঝড়ে মন্দিরের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাই সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপরে আমরা রওনা দিলাম নবগ্রহ মন্দির দেখতে। মন্দির পাওয়ার আগে একটা দীঘি, তার পাড়ে একটা বট গাছ ডালপালা মেলে নদীর উপরে ঝুঁকে আছে। দীঘিতে বাচ্চারা হুটোপুটি করছে, এক ধারে মহিলারা স্নান করছে, একদম টিপিক্যাল গ্রাম বাংলার ছবি যেন। দীঘির পাড় ঘেঁষে একটা আলপথ চলে গেছে, প্রান্তে একটাই বাড়ি। বাড়িটাও ভগ্নদশা। তারই একটা ঘরে নবগ্রহ দেবতা রয়েছেন। এটাকে ঠিক মন্দির বলা চলেনা, গৃহদেবতাই বলা যায়। খানিকটা হতাশ হলাম। এরপর আমরা গেলাম আদিনাথ মন্দির। এই আদিনাথ মন্দিরের জন্যেই মহেশখালী প্রসিদ্ধ। আদিনাথ মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনী আমার আগের একটা পোস্টে বিস্তারিত লিখেছি। মন্দিরটি খুবই সাদামাটা। আকর্ষণ করার মতো কিছুই নেই। শুধু ধর্মীয় টানেই মানুষ সেখানে ছুটে যায়।

মন্দিরের বাইরে অনেক দোকান। পুরো এলাকাটি ঘুরে এইটুকু বুঝলাম যে খুবই গরীব একটা এলাকা। ঝড়ের ফলে ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে প্রচুর। তিনদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। কিন্তু মানুষজনকে দেখে মনেহলো যে ওনারা এটাতেই অভ্যস্ত। যাই হোক, এরপর আমাদের ফেরার সময় হয়ে এলো। আমরা যেদিকে নেমেছিলাম, সেদিকে আর যাওয়া সম্ভব হলো না। কেননা ভাঁটা শুরু হয়ে গেছে, জল অনেকটা দূরে চলে গেছে। আমরা আরেকদিকে গিয়ে আমাদের বোটে উঠলাম। ফেরার সময়ে আর একটুও ভয় লাগেনি। দুপুরের মধ্যেই আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। লাঞ্চের পরে সবাই একটু রেস্ট নিলাম। সন্ধ্যার দিকে উল্টোদিকে একটা বাজারে গেলাম। কিন্তু কিছুই কেনা সম্ভব হলো না। বাজার ঘুরে আমরা তিনজন আবার বীচে গেলাম। বাকিরা হোটেলে ফিরে গেলো। বীচে সন্ধ্যার আলো আঁধারি সমুদ্রের গর্জন বেশ কিছুক্ষণ উপভোগ করে ফিরলাম। হোটেলের উল্টোদিকের রাস্তায় একটা খুব সুস্বাদু মালাই চা খেলাম। চায়ের দোকান পেরিয়েই সারি সারি শুটকি মাছের দোকান। একটা পছন্দসই দোকান দেখে ঢুকলাম। অনেক দেখার পরে খানিকটা শুটকি কিনলাম। তারপর হোটেলে ফিরে ব্যাগপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পরেরদিন ভোর পাঁচটায় আমাদের বেরোতে হবে। সেজন্যে তাড়াতাড়ি ডিনার করতে চলে গেলাম। কিন্তু ডিনারের পরে রাস্তায় একটু হাঁটতে ইচ্ছে হলো। হাঁটাহাঁটি করে যখন রুমে ফিরলাম, তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি শুরু হলো।

শেষ বেলায়, কক্সবাজারে আমাদের হোটেল সম্পর্কে একটু বলি। হোটেলের নাম ‘হোটেল সি কক্স ‘। একদম প্রপার লোকেশনে অবস্থিত। আমাদের বুকিং টা co-ordinate করেছিলেন ম্যানেজার রানা ভাই নবী ভাই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন এবং বুকিংও নবী ভাইই করেছেন। রানা ভাই খুব ভালো একজন মানুষ। প্রতি বেলায় আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের সময় নিজে উপস্থিত থেকে তদারকি করেছেন। এমনকি ফিরে আসার পরেও মেসেজ করেছেন।এছাড়াও হোটেলের সব স্টাফের ব্যাবহার খুব ভালো, নিরাপত্তাজনিত কোনরকম কোনো সমস্যা নেই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি হোটেল। দেশের বাইরে রয়েছি, একমুহুর্তের জন্যেও এই বোধটা আসেনি। পরদিন যেহেতু দুপুর ১২.৩০ এ আমাদের চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন, বাসের টাইমের সঙ্গে মিল হলো না, তখন রানা ভাই একটা গাড়ি ভাড়া করে দিলেন, যেটা পরেরদিন আমাদের চট্টগ্রাম স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আসবে। রাতে গাড়ির ড্রাইভারও ফোন করে কনফার্ম করলেন



আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!