বিশ্বজিৎ পাল বাবু:
পাহাড় আর টিলার মাটি কেটে বানানো হচ্ছে সমতল। আর সমতল কেটে করা হচ্ছে পুকুর। আর এই মাটি কাজে লাগানো হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা রেললাইন প্রকল্পে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার শিবনগর ও মিনারকোট গ্রামে চলছে কাটাকাটি খেলা।
২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ স্থাপনের চুক্তি করেন। ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রকল্পটি চালু হলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮০ কোটি রুপি। এর মধ্যে ভারতের পাঁচ কিলোমিটার অংশের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৮০ কোটি রুপি ও বাংলাদেশ অংশের ১০ কিলোমিটারের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪০০ কোটি রুপি (৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা)। এর মধ্যে ভারত থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে ৪২০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ৫৭ কোটি ছয় লাখ টাকা বাংলাদেশের সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় করা হচ্ছে। ২০২১ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আখাউড়া থেকে আগরতলা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে গঙ্গাসাগর স্টেশন থেকে শিবনগর সীমান্ত পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন মাটি ফেলা হচ্ছে। এসব মাটি কেনা হচ্ছে মিনারকোট ও শিবনগর থেকে। সেখানকার অন্তত পাঁচ-সাতটি পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি দেওয়া হচ্ছে প্রকল্পে। এ ছাড়া জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করে পুকুর করে ফেলা হচ্ছে। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই ভেকু দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি নেওয়া হচ্ছে ট্রাকে করে।
একাধিক সূত্র জানায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলাকার লোকজনের কাছ থেকে ৫০ পয়সা থেকে শুরু করে এক টাকা ফুট দরে মাটি কিনছেন। এ সুযোগে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট সেখানে জমি কিনে নিচ্ছে। পরে ওই জমি থেকে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের কাছে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, মাটি কাটতে গিয়ে রেলওয়ে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভেকু ও ট্রাক ব্যবহার করা হচ্ছে। মূলত স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি খাল থেকে মাটি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নরম মাটি নিতে না চাইলে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহের কথা চিন্তা করা হয়।
দক্ষিণ মিনারকোট এলাকায় দায়িত্বরত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা প্রহরী জানান, রাজীব ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তি এখানে জায়গা কিনেছেন। তিনি ভেকু দিয়ে এখান থেকে মাটি কেটে বিক্রি করছেন। এলাকার আরো কয়েক জায়গায় এভাবে মাটি কাটা হচ্ছে।
তবে আখাউড়ার পৌর এলাকার রাধানগর কলেজ পাড়ার বাসিন্দা, আমেরিকাপ্রবাসী মো. রাজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই শাওন এখানে একটা জায়গা কিনে মাটি বিক্রি করছেন। রেলওয়ের উন্নয়ন কাজে মাটি লাগানো হচ্ছে। তবে কোনো ধরনের পাহাড় বা টিলা কাটা হচ্ছে না। মাটি কাটার জায়গাটি কাগজপত্রে সমতল ভূমি।’
প্রকল্পের কাজে মাটি বিক্রি করা মো. খায়রুল বাশার রিপু নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি নিজ জমিতে একটি পুকুর বানাচ্ছেন। যে মাটিটা কাজে লাগবে না সেটা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তবে এলাকার কোথাও পাহাড় বা টিলাভূমি কাটা হচ্ছে না।
রেলওয়ের প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টেক্সমেকোতে কর্মকর্তা মো. রিপন শেখ বলেন, ‘পাহাড় কিংবা টিলা কেটে মাটি নেওয়া হচ্ছে না। অনাবাদি জমি থেকে মাটি কেনা হচ্ছে। যাদের জায়গা তাদের কাছে থেকেই মাটি কেনা হচ্ছে।’
মনিয়ন্দ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. কামাল ভূঁইয়া পাহাড় ও টিলাভূমি কাটার কথা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি বলেন, ‘শিবনগরে দুটি জায়গা থেকে মাটি কাটা হচ্ছিল। আমি জানার পর পরই কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। এখন সেখান থেকে মাটি কাটা হচ্ছে না।’
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর-এ আলম বলেন, ‘একজন সংবাদকর্মীর মাধ্যমে মাটি কাটার খবর পাই। সঙ্গে সঙ্গে মাটি কাটার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে অংশটুকু গর্ত করা হয়েছে সেটিও ভরাট করে দেওয়া হবে। বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপপরিচালক মো. নূরুল আমীন বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যও যদি পাহাড় বা টিলা কাটা হয় সেটাও অপরাধ। এ ধরনের খবর পেয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com