ব্রেকিং

x

ছোট গল্প

স্বপ্ন চারিণী

সোমবার, ১০ মে ২০২১ | ১০:১১ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্ন চারিণী
তাহিদা আক্তার সেলিনা

আজ সারাদিনই মনটা কেমন যেন লাগছে। কেমন মন খারাপ একটা ভাব। অথচ কয়দিন ধরে মন খারাপের মতো কিছু ঘটেনি। অফিসেও এমন কোন ঝামেলা হয়নি। তারপর ও এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আম্মাকে বললাম। আম্মা বললেন, দেখতো সবাইকে একবার করে ফোন, সবাই ভালো আছে জানলে হয়তো মন ভালো লাগবে। অনেক সময় আপন কারো বিপদ হলে এমন লাগে।
তাই করলাম। না, সবাই ভালো আছে। তারপরও মন খারাপ ভাবটা যাচ্ছে না। রাতে ঘুম আসছিল না। কি করবো বঝুতে পারছি না। বই নিলাম একটা। শুয়ে শুয়ে পড়লে হয়তো ঘুম চলে আসবে। কোথায় কি, ঘুমের গোষ্টি শুদ্ধ উধাও। হঠাৎ মনে হলো ছাদে যাই, একটু ঘুরে আসি। মাত্র তো রাত দশটা। আম্মা আব্বা ঘুমিয়ে গেছেন। হাকিমীকে বললাম, তুই কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়িস, দরজা খোলা থাক। আমি ঘন্টাখানেক পরে চলে আসবো। ছাদে চিলেকোঠায় থাকে ঐশী আর ওর মা। ওদের ঘর পার হওয়ার সময় উঁকি দিলাম, ঐশী পড়ছে, ওর মা শুয়ে টিভি দেখছেন।
আমাকে দেখে মেয়েটা বলে উঠলো, আন্টি আপনি! ঘরে আসেন। না, ঘুম আসছিল না, তাই ছাদে এলাম। আজ বেশ জোস্না, পড়া শেষ করে এসো দেখবে। আমার কাল এক্সাম, আম্মুর ও মাথা ব্যাথা করছে। সরি আন্টি, অন্য একদিম যাবো। হেসে বললাম, আচ্ছা মন দিয়ে পড়ো।
ছাদে দেখি ভরা জোস্না, যেনো মশাটাও দেখা যাচ্ছে। এতো সুন্দর রাত, মনটা যেনো আরো খারাপ হতে লাগলো। কেমন যেনো হারিয়ে গেছে কিছু, শেষ হয়ে কিছু, না পাওয়ার কষ্ট, এমন লাগছে।
একটু পরই হাকিমী এসে মোবাইলটা হাতে দিয়ে বলল, আফা আফনে মোবাইল নিয়া আসেননাই কেন? একশবার ফোন আসছে। ধরেন, আমি ঘুমাইতে পারতাছিনা এইডার জ্বালায়, বলে ফোনটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো।
ফোন হাতে নিয়ে দেখি সত্যিই কুড়িটা মিসকল, তার মধ্যে মুন্না ভাইয়েরই পনের টা। কল ব্যাক করতে ভালো লাগছিল না। কয়দিন পরপরই উনার ফোন অনেক কষ্ট দেয়। আমার ক্ষতটাতে আরো জ্বালা ধরায়! থাক, ফোন দিতে ইচ্ছে করছে না। জোস্না দেখে যদি মনটা ভালো হয়ে যায়, ঘরে চলে যাবো। হঠাৎ একটু শীত শীত লেগে উঠলো। পাশে মনে হলো কেউ একজন এসে দাঁড়ালো। এতো আলসেমি ধরলো ফিরে তাকাতে ও ইচ্ছে করছে না।
কেমন আছিস শেলী? আজ আমাকে খুব মনে পড়ছে তোর, তাই না?
মুন্নার কন্ঠ শুনতে পেয়েই ঘুরে তাকালাম পেছন ফিরে। আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে। সারা শরীর কেঁপে উঠলো। বসে ছিলাম ছাদের সিমেন্টের চেয়ারে। উঠে ঘুরে তাকালাম, সত্যি কি মুন্না! কাছে এসে হাত ধরে বলল, আমাকে ভাবছিস? আগে যদি এমন করে অন্তত একবার ভাবতিস আজ এমন হতো না। আমি তোর কাছ থেকে দূরে চলে যেতাম না। বার বার তোর কাছে এসেছিলাম, তুই ফিরিয়ে দিয়েছিলি। বল কিসের অহংকারে? জানতিস পাগলের মতো চেয়েছিলাম তোকে। আর তুই, এতো অহংকার কেন তোর?তারপর যেদিন বিদায় নিলাম তোর চোখের সামনে, তখনও তো একবার বলতে পারতিস ভালবাসিস, মিথ্যে করেই না হয়…
মুন্না কি বলছে আর আমার কানে যাচ্ছে না। মনে পড়লো আজ ২৩ অক্টোবর, আজই তো, হুম। আজকের এইদিনটাই সব উলটপালট করে দিয়েছিল আমার। সামনে এসএসসি পরীক্ষা। টেস্ট পরীক্ষার আগে স্কুলের কোচিং ক্লাস শেষে মুন্না ক্লাসের সবার সামনে আমার হাত ধরে বলে উঠলো, শেলী তোকে এতোদিন ধরে বলে যাচ্ছি, কোন জবাব দিস না। আজ সবার সামনে আমি জবাব চাই। তুই আমাকে ভালোবাসিস কি না বল? এখনই!
আমি বলেছিলাম, মুন্না আমার চিন্তা ভাবনার সাথে তোর মিলে না। তাছাড়া তোকে অনেকবার বলেছি, আমার পক্ষে এইসব ভালোবাসাবাসি সম্ভব না। এখন পড়াশুনার সময়।
সাথে সাথে হাতটা ছেড়ে দিয়ে মুন্না বলল, তাহলে তোর জবাব?
আমার জবাব সবসময়ই ঐ একটাই। সারা ক্লাস হা করে তাকিয়ে আছে। সবাই জানতো আমি আর মুন্না খুব ভালো বন্ধু। আমি পড়াশুনায় খুব সিরিয়াস টাইপ স্টুডেন্ট আর মুন্না ঠিক তার উল্টো। এইবার টেস্টে পাস না করতে পারলে ওকে স্কুল থেকে বের করে দেবে। ওকে পাস করানোর দায়িত্ব নিলাম। ছোটবাচ্চাদের মতো ধরে ধরে সব কয়টা সাবজেক্টের পুরো সিলেবাস পড়ালাম দিনরাত এক করে। আর সেটাকেই এই ছেলে রুপ দিলো কোনদিকে!
মুন্না আমার হাত ধরে দৌড়ে ক্লাসরুম থেকে জোর করে টেনে বের করে নিয়ে এলো স্কুলের মাঠে, তখন এসেম্বলি হচ্ছিলো। টিচার, জুনিয়র স্টুডেন্ট সবার সামনে চিৎকার করে নাটক সিনেমার মতো করে বলতে শুরু করলো, শেলী তোকে ভলোবাসি, তুই আমাকে সবার সামনে বল, ভালোবাসিস, আমাকে ফিরিয়ে দিবি না। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। আমি রাগে লজ্জায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর গালে একটা চড় মেরে মেয়েদের কমনরুমের দিকে দৌড় দিচ্ছিলাম।
মুন্না চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, আমি যাচ্ছি, মনে রাখিস তুইও কোনদিন ভালো থাকবি না। বলেই স্কুলের গেট দিয়ে বের হয়ে সামনের বড় রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ালো। টিচার স্টুডেন্ট সবাই কি করবে বুঝতে না পেরে ওর পেছন পেছন দৌড় দিলো। ততক্ষণে দ্রুত গতিতে ছুটে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে দিলো মুন্নাকে রাস্তার পাশে। লিপি এসে কমনরুম থেকে আমাকে টানতে টানতে রাস্তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, কাঁদছিল ও। কি বলছিল একটা শব্দও বুঝতে পারছিলাম না। রাস্তার পাশে জটলা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলাম হেড স্যারের কোলের মুন্নার মাথাটা, রক্তে মাখামাখি। আমাকে দেখেই বলে উঠলো, এদিকে আয়, একবার অন্তত বল ভালোবাসিস, মিথ্যেই বল। মাটিতে বসে পড়লাম। ওর মাথাটা কোলে নিয়ে বললাম, তুই এটা কি করলি? চোখ দুটো খোলা, আমার বাম হাতটা চেপে ধরা, মুখে বিজয়ের হাসি নিয়ে চলে গেলো। আমি বলতে পারিনি, ভালোবাসি, মিথ্যে করেও না।
অনেক রাতে ঘুমাতে পারিনি, স্কুলে যেতে পারিনি। পরীক্ষা দিলাম শুধু এসে। সেই সময় সবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া গুলো আরো মাথা খারাপ করে দিতো। আমার জন্য মুন্না মারা গেছে, আমি অহংকারী, ওর সাথে প্রেম করে অস্বীকার করেছি… ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঐ শহর ছাড়লাম এইচএসসি দিয়ে। ঢাকায় চলে এলাম। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। একদিন এক সিনিয়র ভাই এসে বললেন, তেমার নাম শেলী, চাটগাঁ থেকে এসেছো, বাড়ী ফেণী। পরিচিত হতে আসলাম, আমার বাড়ী চাটগাঁ তাই। আমার নাম মুন্না। শুনেই গা কেঁপে উঠলো। তাকালাম ভালো করে। না মুন্নার সাথে কোন মিল নেই। একদিন দুইদিন, এইভাবে কথা বলে ভাব হলো।
একদিন মুন্না ভাইয়ের বান্ধবী রুনা আপু এসে সরাসরি বলে বসলেন, এই শেলী আমাদের মুন্না তোকে পছন্দ করে, খুব ভালো ছেলে ও।তোর কি মতামত, ভেবে জানাইস।
রুনা আপু, সরি আমি এই ব্যাপার গুলোতে নেগেটিভ। আমি এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি না।উনাকে আমার পক্ষ থেকে সরি বলে দিয়েন।
আরে, এখনই জবাব চাচ্ছি না রে। তুই সময় নে, চিন্তা কর। মুন্না বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বেশ অবস্থা সম্পন্ন। বাবা কলেজের প্রিন্সিপাল। তুই ভালো করে ভেবে দেখ।
আপু, আসলেই আমার ভাবনার কিছু নাই।
কেন? তোর কি এফেয়ার আছে অন্য কোথাও?
না, তা নেই।
তাহলে কি প্রবলেম? কোন দুঃর্ঘটনা আছে? আমি আনমনা হয়ে গেলাম।
রুনা আপু ভালো করে তাকিয়ে বললেন, আরে অতীতে কিছু থাকলেও সমস্যা নেই। জানিস, আমরা থার্ড ইয়ারে পড়ছি। তোদের আগে আরো মেয়েরা আসছে। কত ক্ষেপাতাম ওকে। তুই এতো স্মার্ট একটা ছেলে, এতো সুন্দরীরা আসছে। পছন্দ হয়না, কার জন্য অপেক্ষা করছিস? আর আজ এমন একজনকে পছন্দ করলো, যে কিনা তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। মুন্না কিন্তু স্টুডেন্ট ও ভালো।
আপু, প্লিজ। মুন্না ভাই একবারে দেখেই ভালো লাগার মতো একটা ছেলে। আমার ও পছন্দ উনাকে।আমার নিজেরই সমস্যা আছে।
আচ্ছা, তুই তারপরও ভেবে দেখ। ছেলেটাকে কষ্ট দিস না। আমি গেলাম। আবার আসবো পরে, হ্যাঁ শোনার জন্য।
বহুদিন পেছনে লেগে ছিলেন মুন্না ভাই। ক্যাম্পাসে সবাই জানতো আমাদের কথা।
একদিন আমার এক ফ্রেন্ড রাজু এসে বলল, দিদি সেদিন থার্টি ফাস্ট নাইটে মুন্না ভাই অনেক ডিংক করেছিল। হলের কমন রুমে সিনিয়র জুনিয়র সবার সামনে এসে আমাকে বলছে, রাজু শেলীকে বলো ও যদি আমাকে একসেপ্ট না করে, এই বোতল আর ছাড়বো না।
দিদি, তোর সমস্যা কোথায়। পুরাতন কথা ভুলে যা। মুন্না ভাই আজকাল আসলেই ভালো ছেলে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং রুম থেকে বের হয় না, ক্লাসে যায় না, মাঝ রাতে কোথা থেকে আসে মদ খেয়ে। আমার পছন্দের একজন বড় ভাই, চোখের সামনে পাল্টে গেলো। তুই কি করছিস? আবার তো সেই একই কাজ করছিস। এক মুন্নার জন্য আর এক মুন্নাকে একই পথে ঠেলে দিচ্ছিস।
একদিন মুন্না ভাইকে ডেকে পাঠালাম। রাজু সহ বটতলায় গেলাম আমরা। সব বললাম। এরপর বললাম মন দিয়ে পড়াটা শেষ করতে। আমি নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারলে জানাবো উনাকে।
ভার্সিটি পাস করে যাওয়ার পর জবে ঢুকে বাসায় প্রপোজালও নিয়ে গেছিলেন। সবাই পছন্দ ও করেছিল। আমার ভেতরের মুন্না তো আমাকে ভেতর থেকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। কোথাও মন বসাতে দেয় না।
মুন্নাকে ভুলতে পারলাম না। প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতাম। মুন্নার সেই রক্ত মাখা মুখ আজও তাড়া করে। প্রায় রাতই নির্ঘুম কাটে এখনো। আজ মুন্নার মৃত্যুবার্ষিকী, তাই সারাদিন এমন লাগছিল। হঠাৎ ঐশীর ডাকে ঘোর কাটলো। পাশ দিয়ে যেনো ছায়ার মতো মুন্না চলে গেলো।
আন্টি একা একা এতোক্ষণ ছাদে কি করছেন? কার সাথে কথা বলছিলেন? ফোন বেজেই যাচ্ছে। ধরছেন না। আমার পড়া শেষ। ছাদের গেটে তালা দেবো, ফোনের শব্দে এসে দেখি আপনি এখনো আছেন।
স্বম্ভিত ফিরে পেয়ে বললাম, কয়টা বাজে? মোবাইলে দেখি রাত বারোটা। আবারও কল, আটটা, মুন্না ভাই। এতো রাতে ব্যাক করবো না। কাল সকালে করবো। ঐশীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘরে এসে চোখে পানির ঝাপটা দিলাম। মাথায় একটু ঠান্ডা তেল দিলাম। আম্মা বলেন, ঠান্ডা তেল দিলে ঘুম আসবে। আমার আসে না, তাও দিলাম। একটা ক্লোবাম খেয়ে বিছানায় আসলাম। আবার ফোন, মুন্না ভাই। ধরবো না, ধরলেই তো সেই একই কথা। শেলী কি চিন্তা করলে? নিজেও বুড়ী হয়ে যাচ্ছো, আমাকে ও বুড়ো বানালে। আর শুনতে ভালো লাগে না। এক মুন্নার ক্ষত বয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্লান্ত। অপরধবোধ আমাকে হাসতে দেয় না। একটু সুখ স্বপ্ন দেখতে দেয় না। রাতে ঘুমাতে দেয় না। ঘরে, অফিসে, প্রতিবেশীদের সামনে কোথাও কিছু বলতে দেয় না। কুড়িটা বছর পার হয়ে গেলো, আজো কোলের উপর শেষ নিঃশ্বাসের শব্দটা পাই।


লেখক -তাহিদা আক্তার সেলিনা
সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার
সোনালী ব্যাংক লি:, ঢাকা।


আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!