ব্রেকিং

x

করোনাকালে ক্রিটিকাল কেয়ারঃ চার

কিভাবে করোনা যোদ্ধা হলাম

সোমবার, ০৩ মে ২০২১ | ৮:১২ অপরাহ্ণ

কিভাবে করোনা যোদ্ধা হলাম
ডাঃ নিবেদিতা নার্গিস

বুকে ব্যথা নিয়ে ভোরবেলা ঘুম ভেংগে যায় শওকত ভাইয়ের। শওকত ভাই আমার বান্ধবী রুনুর বর।প্রথমে এসিডিটি ভেবে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু সিম্পটম রিলিফ না হওয়ায় তাকে হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্রুত ভর্তি হওয়ার পরে ধরা পড়ে ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক। জীবন রক্ষার ইঞ্জেকশন পুশ করা হয় নাভির নীচে। রক্তচাপ খুব কম। ডোপামিন সহ রেফার করা হয় ঢাকায়। লক ডাউনের কারণে পথিমধ্যে সময় অপচয় হয়নি। বিকেলে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তির পর পরই এ্যানজিওগ্রাম করার সিদ্ধান্ত হয়। ব্লক ধরা পড়ে এবং রিং পরানো হয়। হায়াতের মালিক আল্লাহ। এই সময়ে এতো বড় বিপদ! পরদিন সকালে রুনু বিস্তারিত জানায় আমাকে। আমি যাবার জন্য তৈরি হই। রুনু নিজেই এসে আমাকে নিয়ে যায়। এগারো দিন পরে এপ্রিলের পাঁচ তারিখ ঘর থেকে বের হয়েছি আমি। ভিজিটিং আওয়ার নয় বলে এখন সি সি ইউতে যাওয়া নিষেধ। আই ডি দেখিয়ে আমি একা প্রবেশের অনুমতি পাই। দেখতে পাই এখনো কিছু সাপোর্টিং ইঞ্জেকশন দেয়া হচ্ছে সিরিঞ্জ পাম্পে। সময়মতোন চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে বলে ই সি জি আগের অবস্থায় ফিরেছে। রোগীর সাথে কথা হয়। সাহস দিই শওকত ভাইকে। চোখ দিয়ে পানি গড়ায় উনার। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে উনার জন্য দোয়া করি। বিরাট এক ঝড় সামাল দেয়া বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে পেরে আনন্দ অনুভব করি।


এই রুনু স্কুলের রিইউনিয়নের সময় কতো যে আদর আপ্যায়নে সবাইকে ভাসিয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির কারণে আর কেউ না এলেও আমি আসতে পেরে ধন্য। জানি সবার দোয়ার কারণেই সুস্থ হয়ে ফিরেছেন শওকত ভাই, আলহামদুলিল্লাহ। ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছিলো দফায় দফায়। দিন দিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। আশংকাও সত্যি হচ্ছে দিন দিন। সবচাইতে বেশি ঝুঁকি নিয়ে সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া কাজ করে ইতিমধ্যে প্রচুর স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের মৃত্যু হয় ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে।


প্রথম ডাক্তারের মৃত্যু সংবাদ আসে ১২ তারিখ।মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মইনুল মৃত্যুবরণ করেন আই সি ইউ তে ভেন্টিলেটরে থাকা অবস্থায়। ইনিই প্রথম চিকিৎসক যিনি এভাবে প্রাণ দিলেন। করোনা পজিটিভ রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে তিনি প্রথম শহীদ হলেন। সেবার নববর্ষের শুরুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্দেশ্যে ধনাত্মক বক্তব্য প্রদান করেন। যুদ্ধের ফলাফল যাই হোক না কেন সমুখ যোদ্ধাদের সাহস দেয়ার বিকল্প নেই। সংকট মোকাবেলায় সকলে একযোগে এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া বাঞ্চনীয়।

গতবছর করোনার শুরুতে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম নতুন হাসপাতালে জয়েন করার প্রস্তাবে। মাঝের দুইমাস নিরবিচ্ছিন্নভাবে লকডাউন মেনে বাসায় থেকেছি। এসময় একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হইনি। মাঝে মাঝে অনলাইনে কথা বলেছি পরিবার পরিজন কিম্বা বন্ধুবান্ধবের সাথে। পেন্সিল গ্রুপে আমার দেয়া নাম্বারটি থাকায় এ পর্যন্ত অনেকগুলি পেশেন্টকে পরামর্শ দেয়ার সুযোগ হয়েছে। আমি এটুকু সেবা করতে পেরে বেশ আনন্দিত। প্রত্যেকেই কোন না কোন সমস্যা নিয়ে নক করেছে। করোনার ব্যাপারেও কেউ কেউ জানতে চেয়েছে। সেগুলির ব্যাপারে আমার দিকনির্দেশনা যদি কাজে লাগে তাহলেই আমি সার্থক।

গতবছরও রোজার মাসটা নিরিবিচ্ছিন্নভাবে ইবাদতে মধ্যে মগ্ন থাকার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম। অবস্থার পরিবর্তনের আশা রেখেই সামনের দিনগুলি অতিবাহিত করেছি। রমজানের পরেই আমার ডাক আসে ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট প্রধান হিসেবে জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে। সেসময়ে মনে হয়েছে আল্লাহ নিজেই আমাকে এভাবে নির্বাচিত করেছেন। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের শুশ্রূষার দায়িত্ব মেনে নিলাম সাহসিকতার সাথে। সৃষ্টিকর্তার ইশারায় আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিই। জুন মাস থেকে আমি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ শুরু করি আল্লাহর উপর ভরসা করে।

-লেখক-ডাঃ নিবেদিতা নার্গিস
এফ.সি.পি.এস,এম.ডি
সহযোগী অধ্যাপক এবং হেড অফ ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট
জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আইচি নগর, উত্তরা, ঢাকা।

আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!