ব্রেকিং

x

কী লিখি কেন লিখি: হাসনাত লোকমান

কী লিখি কেন লিখি: হাসনাত লোকমান
হাসনাত লোকমান

কী লিখি কেন লিখি
কী লিখি? সত্যিই তো যৌক্তিক প্রশ্ন। আমরা যারা লেখালেখি করি নিজেকে কি কখনো এ প্রশ্ন করি? হয়তো কেউ করি, কেউ করি না। তবে প্রত্যেকের ভেতর এ প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া জরুরি। বিশ্বসংসারে লেখার হাজারো অনুষঙ্গ। একেকটি অনুষঙ্গের লীলারঙ একেক রকম। রঙের এই বিচিত্র প্রবাহ একেকজনকে একেকভাবে প্রভাবিত করে, আলোড়িত করে। আমাকে আলোড়িত করে মানুষ, স্বদেশ, স্বদেশের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। আমি বিশ্বাস করি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ বিশ্বাস করি- স্বদেশ আমার মাথার মুকুট, প্রকৃতি জীবনধারায় সুরের ঝংকার। যে ঝংকারে দৃষ্টি সত্য-সুন্দরে নিবিষ্ট হয়। লেখার জন্য প্রয়োজন ভাবের গভীরতা, লাগসই শব্দের প্রয়োগে বাক্যের বিন্যাস। এক কথায় ভাব ভাবনা আর ভাষার যথার্থ মেলবন্ধন। আমি কী লিখি, হয়তো ছাইপাঁশ। তবে বিশ্বাস করি- অনাদিকালের পাঠক লেখার বিচারক।
আমি লিখি প্রাণের অমোঘ তাগিদে। আমার লেখার ভেতর দিয়ে জাগতিক জীবন কতটুকু স্পন্দিত হলো, সে ভাবনা আমাকে তেমন তাড়িত করে না। আমাকে তাড়িত করে আমার আমি। তবে আমিত্ব নয়। আমার আমি আমাকে বলে দেয় মগ্ন চৈতন্যের কথা। যে চৈতন্যে নিজের সত্তা সবার আগে উদ্ভাসিত হয়। মনে করিয়ে দেয় নিজের প্রতি ভালোবাসার দায়বোধ। সুতরাং বলতেই পারি আমি আমার জন্যে লিখি, আমাকে ভালোবাসি বলেই লিখি। অভিজ্ঞতার সমুদ্র-গাহনে দ্রোহ সঞ্চয়ের শ্রমিক নিষ্ঠায় এক একটি শব্দকে সাজিয়ে দাঁড় করাতে হয় কবিতার ভিত, মানুষের অগ্রসর কর্মকাণ্ডের সংলাপ স্বরলিপি। বিশ্বাস করি নিজের প্রতি উচ্চকিত ভালোবাসা থেকেই সমষ্টি দীক্ষা নেয় প্রাণপ্রাচুর্যের, পুলকিত হয়, উল্লসিত হয়। চাঞ্চল্যে তাকায় ইতিউতি, দেখে চারপাশের বর্ণময় ক্যানভাস- যা থেকে উন্মোচিত হয় আত্মোপোলব্ধির সিংহদুয়ার।
লিখি একটি ঘোরের ভেতর। যে ঘোর তৈরী হয় সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় অপ্রতিরোধ্য যন্ত্রণা থেকে। অনেকেই এটিকে প্রসবযন্ত্রণার সাথে তুলনা করেন। আমি তা করতে রাজি নই। আমি মনে করি এ যন্ত্রণা প্রেয়সীর সাথে মিলনাকাঙ্ক্ষার যন্ত্রণা। যে যন্ত্রণা লাগবের পর সে মুহূর্তে নিজেকে পৃথিবীর এক নম্বর সুখী মানুষ বলে অনুভূত হয়।
পাহাড়ের বুক চিরে যে প্রবহমান ঝর্নাধারা, তার উৎসমূল আবিষ্কার জরুরি নয়, জরুরি দৃশ্যমান ঝর্ণার সৌন্দর্য আমাকে আপনাকে চমকিত করলো কিনা। দৈনিকে লিখি, শিল্প-সাহিত্যের সাময়িকীতে লিখি। আজকাল তো ফেইসবুকও লেখার মাধ্যম। হতে পারে এ মাধ্যম সস্তা। তবুও লিখি। কোথায় লিখলাম বড় কথা নয়, বড় কথা লেখা সুগঠিত হলো কিনা, সুখপাঠ্য হলো কিনা, নন্দনতত্ত্বের বিচারে লেখা দ্যুতি ছড়ালো কিনা। অভিজ্ঞতা, অন্তর্দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতার ধারালো মানদণ্ডকে সম্বল করেই কবি নির্মাণ করেন তার কাব্যসৌধ। কবি তার অতিচেনা নিজস্ব ভৌগোলিক পরিমন্ডলে অন্তর্দৃষ্টির দূরবীক্ষণে মানবিক দুঃখ ও আনন্দের, বিপর্যয় ও বিকাশের, মুগ্ধতা ও উল্লাসের বাঞ্চিত অনুভবের অনুরণন করেন কবিতার শব্দশৈলীতে প্রকরণ প্রকৌশলে।
আমার প্রেরণা বহুমাত্রিক। আমি যখন স্বদেশের কথা বলি তখন আমার প্রেরণা প্রিয় মাতৃভূমি। যখন জাতির পিতার কথা বলি তখন আমার প্রেরণা শেখ মুজিব। এইভাবে যখন মানবতার কথা বলি তখন আমার প্রেরণা লঙ্ঘিত মানবতার শিকার বিপন্ন মানুষ, যখন হৃদয় চর্চার কথা বলি তখন প্রেরণা প্রেম। রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিভিন্ন প্রেরণার উৎসমূলের যুথবদ্ধ নাম দিয়েছেন জীবনদেবতা। এই জীবন দেবতাই কখনো কাব্যলক্ষ্ণী, কখনো মানসী, কখনো উর্বশী। তিনি বলেছেন আমি লিখছি না, আমার দ্বারা কেউ লিখিয়ে নিচ্ছেন। ভেতরে অবস্থান করছেন অধিষ্ঠাত্রী দেবীর মতো। সে যাই হোক, এই লিখিয়ে নেয়াওয়ালা একেক সময় একেকরূপে কথা বলেন। ঋষিকবির মতো আমারও বিশ্বাস প্রতিটি লেখার মূলে থাকে সংগোপন প্রেরণা। আমি বৃক্ষের কথা বলি, আমাকে প্রেরণা দেয় ঘন সবুজের সমারোহ। ফুল পাখি নদী, সমুদ্রের জলনিনাদ আমাকে প্রেরণা দেয়। ব্যক্তিসত্তার আড়ালে বাস করে লেখক সত্তা। ব্যক্তিকে যা স্পর্শ করেনা লেখকসত্তাকে তা স্পর্শ করে না। এই স্পর্শের নামই তো প্রেরণা।
কোন ব্যক্তি বিশেষ আমার লেখালেখির গুরু নয়। সকল অগ্রজের লেখা পড়ি। অনুজদের লেখাও পড়ি। যাঁর লেখা থেকেই কিছু জানার বুঝার শেখার সুযোগ হয় তাকেই আমি গুরু বলে শ্রদ্ধা করি। আমি সুনির্মল বসুর সেই অমৃত বাণী শিরোধার্য করি- ‘বিশ্ব জুড়ে পাঠশালা মোর/সবার আমি ছাত্র।’
চেষ্টা করি যা বলতে চাই তা শিল্পসম্মত প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করতে। একটি অর্থবহ আবহের ভেতর যদি মেসেজটি না আসে তাহলে লেখা তো স্বার্থক হবে না। সুতরাং চেষ্টা করি প্রকাশটি যেন হয় সমষ্টির ভেতর স্পর্শ করা।
লিখে যাচ্ছি। লেখা আরাধনার মতো বিষয়। নিয়তো সেই আরাধনায় আছি। অর্জনের হিসেব করি না। তবে প্রতীতি প্রতিটি কাজের একটি অর্জন থাকে। সেই অর্জন কখনো দ্রুত আসে, কখনো সময় নিয়ে আসে। আমার কাছে মনে হয় একজন লেখকের সব চেয়ে বড় অর্জন একটি পাঠক শ্রেণি তৈরি করা। সে হিসেবে একটি পাঠক শ্রেণি যদি গড়ে উঠে সেটিই হবে অর্জন। গড়ে উঠছে না যে তা নয়। ধীরে ধীরে আমার পাঠক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। এই তৈরি হওয়ার পথটিকে আমি অর্জন বলেই মনে করি।


হাসানাত লোকমান
কবি, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা


আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!