ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের চরলাপাং এলাকায় মেঘনা নদী থেকে অবাধে বালু লুট করা হচ্ছে। ইজারা ছাড়াই প্রতিদিন এখান থেকে অন্তত ছয় লাখ ফুট বালু উত্তোলন করছে পার্শ্ববর্তী নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার প্রভাবশালী একটি চক্র। এতে একদিকে সরকার যেমন বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে স্থানীয় কয়েকটি গ্রাম। পাশাপাশি চড়া মূল্যে বালু মহাল ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানও পড়েছে বিপাকে। অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে চলছে এই লুটতরাজ। এ ছাড়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওই চক্রের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবীনগর উপজেলার নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়নের চরলাপাং এলাকায় পাঁচ থেকে সাতটি ড্রেজার দিয়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ বালু তোলা হয় তার বাজারমূল্য প্রায় ১৫ লাখ টাকা। গত ২০ দিন ধরে রায়পুরার ওই চক্রটি বালু লুট করে যাচ্ছে। এই চক্রের নেতৃত্বে আছেন রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও মির্জাচর গ্রামের বাসিন্দা নূর ইসলাম। তার সঙ্গে মির্জাচরের বাসিন্দা ও ইউনিয়ন বিএনপির কয়েকজন নেতাও রয়েছেন। রীতিমতো অস্ত্রে সজ্জিত ক্যাডার বাহিনীর পাহাড়ায় প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে বালু উত্তোলন। অস্ত্রের ভয়ে স্থানীয়রা প্রতিবাদ করার সাহস পান না।
চরলাপাং গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, গত ২০ দিন ধরে রায়পুরার লোকজন চরলাপাং সীমানা থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলনের ফলে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে চরলাপাং, সাহেবনগর, নাসিরাবাদ, রায়পুরার মির্জাচর, শান্তিপুরসহ কয়েকটি গ্রাম। এসব গ্রামের বাসিন্দারা নদীগর্ভে ঘর-বাড়ি বিলীন হওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন।
নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আলম বলেন, ‘চরলাপাং গ্রামের বেশির ভাগ অংশই নদীবেষ্টিত। অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে এখানকার কৃষি জমি ও ঘর-বাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষজন এসে প্রায়ই অভিযোগ করছেন। বিষয়টি উপজেলা সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) জানানো হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে বলেন- আমি কি নদীতে গিয়ে বসে থাকব? প্রশাসনের কাছে দাবি থাকবে, তারা যেন বালু উত্তোলন বন্ধ করে আমাদের এলাকাকে বাঁচায়।’
এদিকে মেঘনা নদীর জাফরাবাদ বালু মহালটি প্রায় ৭০ কোটি টাকায় ইজারা নিয়ে বিপাকে পড়েছে মুন্সি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এক বছরের ইজারা এরই মধ্যে ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া ইজারার টাকা পরিশোধে দেরি হওয়ায় তিন মাস বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল। এখন কেউ বালু কিনতে এলে রায়পুরার বালুখেকো চক্র অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের থেকে বালু কিনতে বাধ্য করছে। এতে ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানটি লোকসানে পড়ার শঙ্কায় রয়েছে।
মুন্সি এন্টারপ্রাইজের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নবীর হোসেন বলেন, ‘আমরা যে টাকা দিয়ে বালুমহাল ইজারা নিয়েছি- সেই টাকা তুলতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। আশপাশের এলাকা থেকে যেসব ক্রেতা বাল্কহেড নিয়ে আমাদের কাছে বালু কিনতে আসেন- রায়পুরার চক্রটি তাদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নিজেদের কাছ থেকে বালু কিনতে বাধ্য করছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘সাতটি ড্রেজার দিয়ে এখান থেকে প্রতিদিন অন্তত ছয় লাখ ফুট বালু উত্তোলন সম্ভব।’
রায়পুরা বালুখেকো চক্রের হোতা হিসেবে নাম আসা বাঁশগাড়ি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি নূর ইসলামকে অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। এ কারণে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
নবীনগর থানার ওসি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘চরলাপাং এলাকায় নরসিংদী ও নবীনগরের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়। যেহেতু ঘটনাস্থল নদীর মধ্যে এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আগের মতো ভবিষ্যতেও করা হবে।’ বালুখেকোদের অস্ত্র নিয়ে পাহাড়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগে এসিল্যান্ডের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়েছিলাম। আমাদের দেখে তারা পালিয়ে যান। তখন একটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।’
অবৈধ বালু উত্তোলনে মদদ এবং কমিশন নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে নবীনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু মুছার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘ইজারা এলাকায় বাইরে থেকে এসে কারও বালু উত্তোলনের সুযোগ নেই। শিগগিরই ওই এলাকায় বৃহৎ আকারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হবে।’
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com