বিশ্বজিৎ পাল বাবু:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বিজেশ্বর গ্রামের সোহেল সিকদারের সাত শতাংশ জায়গা সড়কে অধিগ্রহণের আওতায় পড়ে। সব প্রক্রিয়া শেষে টাকা (এক কোটি ১০ লাখ) তোলার সময় সোহেলের মাথায় যেন বাজ পড়ে। জমির মালিকানা দাবি করে অভিযোগ করে অপরিচিত কয়েকজন। শেষে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে সেই অভিযোগ প্রত্যাহার হয়।
অধিগ্রহণ হওয়া দেড় শতাংশ জায়গার ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা আনতে চার লাখ টাকা দিতে হয়েছে এক ব্যক্তির। তিনি বলেন, ‘ইতা নিয়া কতা কইলে আমারে মাইরাঅলাইতে পারে। ইতা কইয়া বিফদ পরতাম চাই না।’ নাম প্রকাশ করা হবে না এমন শর্তে তিনি আরো বলেন, ‘বাপ-দাদার সম্পত্তির টেহা আনতে গিয়া যেই জামেলা অইছে। জাগা পায় কইয়া মামলা দিছে। পরে রতন মিয়াসহ কয়েকজন নিজেরার কথা কইয়া আড়াই লাক আর অফিসের কতা কইয়া দেড় লাক টেহা নিছে।’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার নয়নপুরে দাঁড়িয়ে কথা হয় ওই ব্যক্তির সঙ্গে।
ভূমি অধিগ্রহণে এমন চক্রের ‘থাবা’ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ-বিশ্বরোড-ধরখার-আখাউড়া জাতীয় মহাসড়ক চার লেন উন্নয়ন প্রকল্পে। প্রকল্পটি ৫০ কিলোমিটারের ওপরে। এখন চলছে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ। চক্রের টার্গেট কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া। অধিগ্রহণ হওয়া জায়গার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে, অধিগ্রহণের জায়গায় নতুন নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ এঁটেছে এরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এতে জড়িত বলে উপকারভোগীরা বাধ্য হয়ে বাড়তি লেনদেন করছেন। একইভাবে নতুন নির্মাণাধীন স্থাপনার টাকা পাওয়া অনেকটা নিশ্চিত করে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট চক্রটি। অবশ্য যাঁরা চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না তাঁরা ঠকছেন। জায়গা কিংবা স্থাপনার দাম কম দিয়ে তাঁদের আর্থিকভাবে ঠকানো হচ্ছে।
প্রকল্পটির ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা অঞ্জন কুমার দাস এ বিষয়ে চক্র থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সারা দেশে দুটি সিন্ডিকেট কাজ করে। এর একটি জমি নিয়ে অভিযোগ দায়ের করে। পরে জমির মালিকের সঙ্গে আপসের নামে টাকা হাতিয়ে নেয়। অন্যটি অধিগ্রহণ হওয়া জায়গায় নতুন স্থাপনা নির্মাণ করে টাকা নিতে চায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, চক্রটির সঙ্গে তাঁদের কোনো যোগাযোগ নেই।
আখাউড়ায় নকশা পরিবর্তন করে সোজা পথে সড়ক নির্মাণেরও দাবি জানায় স্থানীয়রা। সাতপাড়া থেকে যেভাবে আঁকাবাঁকা করে সড়ক নেওয়া হয়েছে, এর প্রতিবাদ জানায় তারা। আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘সোজা না করে আঁকাবাঁকা পথ হবে বলে এলাকার অনেক ক্ষতি হবে।’
এদিকে অধিগ্রহণ করা জমির মামলার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, জলিল সরকার, বাবুল হোসেন, রতন মিয়া, সুজন চৌধুরী, তোফাজ্জল খান, খোকন মিয়া, লাল মিয়া, হেলাল মিয়া, চাঁন মিয়ার নাম উঠে এসেছে মামলা করার চক্রের তালিকায়। এর মধ্যে জলিল ও বাবুলকে গত ১৪ জানুয়ারি রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অধিগ্রহণের টাকা ওঠানোর জন্য বাড়তি দিতে না চাইলে বাবুল, জলিলসহ কয়েকজন খলিলুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করেন বলে মামলা আছে। জেলা প্রশাসকের তৎপরতায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখায় বিশেষ করে সন্ধ্যার পরসহ দিনের বিভিন্ন সময়ে ওই দুজনকে প্রায়ই দেখা যেত।
আনোয়ার ও দুলাল নামে নয়নপুরের দুই ভাই এই চক্রের কবলে পড়েছেন। তবে তাঁদের বাড়িতে গেলে এ নিয়ে মুখফুটে কিছু বলতে চাননি। এসব নিয়ে লিখেও কোনো লাভ হবে না বলে তাঁরা মনে করেন।
নয়নপুরের আরমান স্টোরের আরমান মিয়া বলেন, ‘আমার বাড়ির মালিক জায়গার ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আমাকেও ব্যবসা বাবদ এক লাখ টাকার ওপরে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। কিন্তু কারো সঙ্গে যোগসাজশ না করায় টাকা পাচ্ছি না। এমনকি ডিসি অফিসের এলএ শাখায় গেলে সংশ্লিষ্টরা টালবাহানা করে।’
মো. আব্দুল মোনেম শাফি জানান, ১৮ শতাংশ জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়লেও কাউকে বাড়তি কিছু না দেওয়ায় টাকা পাচ্ছেন না। উপরন্তু জায়গার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মুরাদ খান ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে চক্র গড়ে ওঠার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এলাকায় অনেকে বিষয়টি মৌখিকভাবে তাঁকে জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com