ব্রেকিং

x

জামায়াত কার্যালয় দখলে করে আলোচনায় আসেন শাপলু

ছাত্রলীগের মুরাদ শূন্য থেকে কোটিপতি, জামায়াত কার্যালয় দখল করে আলোচনায় শাপলু

শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪ | ৬:৫৫ অপরাহ্ণ

ছাত্রলীগের মুরাদ শূন্য থেকে কোটিপতি, জামায়াত কার্যালয় দখল করে আলোচনায় শাপলু
মুরাদ ও শাপলু

অচেনা মুখ মুরাদ হোসেন। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে মাঝে মাঝে দেখা মিলত নিজ গ্রামে। উপজেলার কমিটির আহ্বায়ক হয়ে এলাকায় হৈহুল্লুড় ফেলে দেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। দুইবার ভাইস চেয়ারম্যান হন। এরপর চেয়ারম্যান হতে গিয়ে ধরাশায়ী হন। তবে শূন্য থেকে কোটিপতি হওয়ার পথে তিনি কোথাও ভুল করেননি। শাহবুদ্দিন বেগ শাপুল। বর্তমানে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাকজিল খলিফা কাজলের ভাতিজি জামাই হওয়ার সুবাদে দুর্দান্ত প্রতাপ তার। সব কিছুতেই নাক গলানোর স্বভাব। কেউ কিছু না জানিয়ে করতে গেলেই দিতেন বাধা। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে আর্থিক অনেক বিষয়ে এই আওয়ামী লীগ নেতা কাজলের নির্দেশনা পালনে তিনি ছিলেন একেবারে সিদ্ধহস্ত। ২০০৭ সালে জামায়াতের কার্যালয় দখলে নিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক ওই দুই নেতা বেশ আলোচিত-সমালোচিত। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু কাতার পাড়ি জমিয়েছেন। বিমানবন্দরে গিয়ে হাত উঁচিয়ে বিদায় জানানোর ভিডিও এরই মধ্যে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে হদিস নেই মুরাদ হোসেনের। যদিও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে অকথ্য ভাষায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার নামেই আখাউড়া থানায় মামলা হয়েছে। কম্বল বিতরণ করতে এসে বাধার শিকার হওয়া আব্দুল্লাহ আল-মামুন নামে এক যুবক গত সপ্তাহে মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় তাদের প্রশ্রয়দাতা আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র তাকজিল খলিফা কাজলকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় জালাল সরকার নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


মুরাদ ব্যবসা করতেন। ব্যবসা থেকে বাৎসরিক আয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। নগদ ছিল ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া স্থাবর কিংবা অস্থাবর নেই। বাবা শাহ জাহান ভূঁইয়ার কাছ থেকে তিন লাখ ও ভগ্নিপতি আবু হানিফ থেকে দুই লাখ টাকা নিয়ে ভোট লড়বেন। ২০১৪ সালে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে গিয়ে হলফনামায় এমনটাই উল্লেখ করেছিলেন মো. মুরাদ হোসেন ভূঁইয়া। ভোটে জেতেন মুরাদ হোসেন।
২০১৯ সালে আবারও তিনি ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হন। পেশায় লেখেন কৃষিজীবী। তবে ব্যবসা বা অন্য খাত থেকে আয়ের কথা উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ তিনি ‘বেকার’। তবে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে বছরে তিন লাখ ২৪ হাজার টাকা সম্মানী পেতেন তিনি। তার হাতে তখন নগদ ১০ গুন বেড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ছিল ৩০ ভরি স্বর্ণ। এটা ছিল ওই সময়ে দেওয়ার হলফানামার তথ্য। ভোট জয়ী হয়ে এবার যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পান মুরাদ হোসেন। একটি ইটভাটার মালিক বনে যান তিনি। যৌথ মালিকানায় ৬০ শতাংশ জমির মালিক হন। যার মূল্য হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে দুই লাখ টাকা। এছাড়া তার ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের বাড়ি রয়েছে, যা পিতা হেবা দলিল করে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন তার বাৎসরিক আয় পাঁচ লাখ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কাছে যে ৩০ ভরি স্বর্ণ রয়েছে সেটি বিয়েতে উপহার হিসেবে পাওয়া বলে উল্লেখ করা হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ইটভাটাটি তিনি এক কোটি ১০ লাখ টাকায় কিনেছেন। এরপর এটাকে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত করতে আরো প্রায় ৪০ লাখ টাকার মতো খরচ করেন। ২০১৯ সালে জমা দেওয়া হলফনামায় আয় হিসেবে সম্মানি ভাতা বাদে আর কিছু না থাকলেও হুট করে কোটি টাকার ইটভাটার মালিক হয়ে যাওয়া নিয়ে মুরাদের বিরুদ্ধে প্রশ্ন থেকেই যায়। ২১ মে আখাউড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘ঐক্যের প্রার্থী’ হিসেবে ভোটে লড়েছেন মো. মুরাদ হোসেন ভূঁইয়া। তবে এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে তার চরম ভরাডুবি হয়, যা পুরো এলাকাজুড়ে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।


স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সর্বশেষ ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটাই দূরে ছিলেন মুরাদ হোসেন। তিনি ইটভাটাসহ অন্যান্য ব্যবসায় বেশ মনযোগী ছিলেন। উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা-সমাবেশেও তিনি খুব একটা উপস্থিত হতেন না। দিনকে দিন তিনি নানা কারণে এলাকায় বিতর্কিত হয়ে ওঠেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের পিএ আলাউদ্দিন বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মুরাদ। চাকরি বাণিজ্যে বেশ পটু হয়ে পড়েন তিনি। এমনকি আখাউড়ার হর্তাকর্তা হিসেবে বিবেচিত আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠজন তাকজিল খলিফাকে পাশ কাটিয়ে অনেককে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি আলোচনার জন্ম দেন।
জামায়াতের কার্যালয় দখলে নিয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনায় আসেন শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু। ঘটনাটি ২০১৭ সালের। তখন তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। দলের একাংশের নেতাকর্মীদেরকে নিয়ে তিনি জামায়াতের কলেজ পাড়ার কার্যালয়ের তালা ভেঙে প্রবেশ করে দখলে নিয়ে নেন। অবশ্য তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ছাত্রলীগের একটি পক্ষ নিজেদেরকে জানান দিতে জামায়াতের পরিত্যক্ত কার্যালয়ে তালা ভেঙে ঢুকে পড়ে।
শাপলু সর্বশেষ আলোচনায় আসেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি মিছিলে বাধা দিয়ে। বাইপাস এলাকার ওই মিছিলে বাধা দিয়ে এক নারী শিক্ষার্থীর হাত থেকে কাগজ টেনে ছিঁড়ে ‘হুয়াট ইজ একদফা’ বলে চিৎকার দেন শাপলু। এরপর থেকেই আখাউড়াতে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্ররা শাপলুকে ধাওয়া দেয়। ৫ আগস্ট শাপলুর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় তার চাচা শ্বশুর তাকজিল খলিফার বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়।
মূলত তাকজিল খলিফার ভাতিজিকে বিয়ে করার পর থেকে শাপলুকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তাকজিল খলিফার নির্দেশে অনেক কিছুতেই ছিল তার নিয়ন্ত্রণ। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যানের পদও বাগিয়ে নেন দলের ওপর ভর করে। যদিও এ পদে দলীয় কোনো প্রার্থী ছিল না।
শাহবুদ্দিন বেগ শাপলু দেশে ছেড়েছেন। তিনি বর্তমানে কাতার আছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রায় এক মাস আগে তিনি দেশটিতে পৌঁছান। ৫ আগস্ট তার রাধানগর কলেজপাড়ার বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুরের পর থেকেই তিনি পলাতক ছিলেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ২১ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক হাতে পাসপোর্ট নিয়ে আরেক হাতে ব্যাগ টেনে স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন শাহবুদ্দিন বেগ। এরপর তিনি হাত উঁচিয়ে বিদায় জানান। ওইদিনই ফেসবুকে শাহবুদ্দিন বেগ লিখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ সকল প্রশংসা মহান রাব্বুল আলামিন এর। শাহবুদ্দিন বেগ আখাউড়ায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতেন। রাজনৈতিক সংগঠনের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনেও তার প্রভাব ছিল। এছাড়া টেন্ডারবাজি, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, জায়গা দখল, স্থলবন্দরে প্রভাব দেখানোসহ নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। আইনমন্ত্রীর সিটিজেন্স ব্যাংক কর্মকর্তা সমীর চক্রবর্তী, একজন সরকারি চাকরিজীবী, ছাত্রলীগের কয়েকজনকে নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলেন তিনি। যদিও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কাছে সাধারণ সম্পাদকের চেয়ে তার গ্রহণযোগ্যতা ছিল কম।
হাত তোলায়ও শাহবুদ্দিন বেগ ছিলেন বেশ পটু। জেলা পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে এসে পার্শ্ববর্তী বিজয়নগর উপজেলার জনপ্রতিনিধিদের ওপর যে হামলা হয় এর নেতৃত্বে ছিলেন শাপলু। সাবেক আইনমন্ত্রীকে ফুল দিতে এসে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যানকে মারধরের ঘটনায়ও শাপলু ছিলেন অগ্রভাগে। স্থলবন্দর এলাকায় চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে একটি ঘটনায় অবশ্য হাত ভাঙে শাপলুর।

আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!