ব্রেকিং

x

সৌদিগামী শত শত শ্রমিকের কাজ নেই, ইকামা নেই

রবিবার, ০৭ জানুয়ারি ২০১৮ | ৪:৫৪ অপরাহ্ণ

সৌদিগামী শত শত শ্রমিকের কাজ নেই, ইকামা নেই

বাংলাদেশের বৃহৎ শ্রমবাজার সৌদি আরবে গত বছরে পাঁচ লাখেরও বেশি শ্রমিক রফতানি হয়েছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, ওমানসহ অন্যান্য দেশে যত শ্রমিক গেছেন, সেই একই সংখ্যক শ্রমিক এবার সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো আছেন। আবার অনেকের দিন কাটছে মানবেতরভাবে। অভিযোগ রয়েছে, লাখ লাখ টাকা খরচ করে যাওয়ার পরও চুক্তি মোতাবেক অনেকেই নিজ নিজ কোম্পানিতে কাজ পাননি। পাননি ইকামাও, যার কারণে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়ার পরও তারা স্বাধীনভাবে কাজ ও চলাফেরা করতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।


এমন পরিস্থিতিতে সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা ও দাম্মামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইকামা ছাড়া অবস্থানকারী বাংলাদেশী শ্রমিকেরা পুলিশি ধরপাকড় অভিযানের কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উপায় না দেখে কেউ কেউ পালিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, দালালের নাম, ঠিকানা উল্লেখ করে দূতাবাসে লিখিত অভিযোগ করছেন। তারপরও দূতাবাস সংশ্লিষ্টরা অসহায় কর্মীদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হচ্ছেন তখন রাষ্ট্রদূত স্বাক্ষরিত অভিযোগগুলো পাঠানো হচ্ছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও ভারপ্রাপ্ত সচিব ড. নমিতা হালদারের দফতরে।


প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ ডিসেম্বর সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ্ রিক্রুটিং এজেন্সি জিএমজি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের (আরএল নম্বর-১১৪৩) মাধ্যমে পাঠানো তিন শ্রমিকের সাথে ‘ফ্রি ভিসার’ নামে কিভাবে প্রতারণা করা হয়েছে তার ফিরিস্তি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন। চিঠির এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘যে কোম্পানিতে কর্মীরা এসে প্রতারিত হয়েছে ওই কোম্পানির নামে কোনো ছাড়পত্র না দিতে দূতাবাস থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু মন্ত্রণালয় সেই অনুরোধ মানেনি, যার কারণে শ্রমিকেরা এসে এখন সমস্যায় আছে।’

জিএমজি অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে সৌদি আরব আসা বাংলাদেশী নাগরিক জসিম উদ্দিন, আব্দুর রহিম ও মোহাম্মদ খোকন হাওলাদারের অভিযোগ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, ‘ডিসেন্ট মাইগ্রেশন’ এর লক্ষ্যে রাষ্ট্রদূত সম্মেলনে আপনার প্রত্যয়দীপ্ত উপস্থাপনা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাচ্ছি, জসিম উদ্দিন (পাসপোর্ট নং-বিএম-০৩৩২৩১৩), আব্দুর রহিম (পাসপোর্ট নম্বর-বিএল-০১০৩৩৪৩) ও মোহাম্মদ খোকন হাওলাদার (পাসপোর্ট নম্বর-বিএন-০৩২৬৫০৮) দূতাবাসে পৃথক তিনটি অভিযোগ করেন। তারা রিক্রুটিং এজেন্সি জিএমজি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, কাজ দেবে বলে তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসায়’ কর্মী আনা এবং কাজ ও ইকামা না পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।

ইকামা, কাজ, খাবার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় এখন তারা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। তাই তারা রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলেছেন। এর মধ্যে অভিযোগকারী জসিম উদ্দিনের রিয়াদে থাকার ব্যবস্থা নেই। বর্তমানে সে দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছে। এ বিষয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন-২০১৩ এর ১৫ ধারা অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক গোলাম মাওলাকে সমস্যা সমাধান করতে বলা হয়। কিন্তু তিনি সুরাহা না করে তাদের কাছে (কর্মী) ইকামা বাবদ আরো ৫ হাজার রিয়াল করে দাবি করেন, যা সৌদি শ্রম আইন অনুযায়ী বেআইনি। এ ছাড়াও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন ২০১৩ এর ২০ ধারা অনুযায়ী ভিসা ট্রেডিং বেআইনি।

রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ আরো উল্লেখ করেন, কর্মীরা সৌদি আরবের আল ফাতাহ আল খালেজি কোম্পানি ফর অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স এবং কন্ট্রাক্টিং সিটিস রেনঞ্জ কোম্পানির কর্মী। এই কোম্পানিগুলোতে কর্মী নিয়োগের অনুমতি না দেয়ার জন্য ইতঃপূর্বে দূতাবাস থেকে মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানো হয়েছিল। তারপরও কোম্পানিগুলোতে কর্মী পাঠানো হয়। আসার পর তারা এই কোম্পানিতে ইকামা, কাজ না পাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যায় পড়েন।

এ অবস্থায় অভিযোগকারী শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা, ইকামা সরবরাহ না করা পর্যন্ত রিক্রুটিং এজেন্সি জিএমজি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড কর্তৃক সৌদি আরবের দুই কোম্পানির ভিসায় পাঠানো সব কর্মীর ইকামা ও কাজ পাওয়ার তথ্য সরবরাহ না করা পর্যন্ত সব কার্যক্রম স্থগিত রাখা দরকার। একই সাথে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো।

প্রতারিত শ্রমিক রহিম  একাধিকবার টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি এখন কী করব? পুলিশ এখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় রেইড দিচ্ছে। যেকোনো সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারি। তাহলে আমি যে ১১ লাখ টাকা খরচ করে এসেছি সেই টাকা কিভাবে শোধ করব? তিনি বলেন, দূতাবাসে গিয়ে আমি জিএমজির মালিক ও দালাল রিয়াজুলের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমার খোঁজও নিতে আসেনি। তিনি বলেন, ‘আমার মতো শত শত শ্রমিক এ দেশে এসে এখন কাজ না পেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ। আবার আমার মতো যাদের ইকামা নেই তারাতো পুলিশের ভয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছে না।

কিন্তু আসার সময় এজেন্সির দালাল আমাকে বলেছিল, তুমি ‘ফ্রি ভিসায়’ গেলে প্রথম মাসেই বেতন পাবে ৬০ হাজার টাকা। এরপর উপরিতো আছে। এটা মনে করে আমি ১১ লাখ টাকা দিয়েছিলাম দালালের হাতে। এখন পালিয়ে পেটে ভাতে আমার এক বন্ধুর দোকানে কাজ করছি। তিনি বলেন, আমার গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ীর পাংশায়। চলতি বছরের ১ মার্চ এসেছি। এখন ডিসেম্বর মাস। আমি স্ত্রী-সন্তানদের জন্য মাত্র ১২ হাজার টাকা পাঠাতে পেরেছি।

এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে রিক্রুটিং এজেন্সি জিএমজি অ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাাধিকারী গোলাম মাওলার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সৌদি আরব থেকে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমার এজেন্সি থেকে যদি তিন হাজার লোক এসে থাকে, তাহলে সেই তুলনায় মাত্র ৩ জন শ্রমিক সমস্যর কথা জানিয়ে দূতাবাসে অভিযোগ দিয়েছে। এটা কি কোনো অভিযোগের মধ্যে পড়ে? ভাত খেতে গেলে দু-একটা ভাত পড়ে। তাদের বিষয়টি আমি দেখছি ভাইজান।

সম্প্রতি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজার সাথে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার মধ্যে আছে ‘ফ্রি ভিসায়’ যাওয়া কর্মীরা। তার মতে, সৌদি আরবে শ্রমিক যাওয়ার কারণে এবার বিদেশে রেকর্ড পরিমাণ ১০ লাখ শ্রমিক যেতে পেরেছে। এখন যেসব রিক্রুটিং এজেন্সির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে, তাদের বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তাহলেই প্রতারণা কমে আসবে।

আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।

Development by: webnewsdesign.com

error: Content is protected !!