ভিক্ষা আর সময়ের অবহেলা নয়, একই সাথে কর্ম আর শিক্ষা।কোমল কচি হাতেই কর্মের হাতিয়ার পাশাপাশি শিক্ষার বই খাতা কলম। শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি জীবন জীবিকার যুদ্ধে ব্যতিক্রমী অদম্য সংগ্রামী দশ বছরের শিশু দোলেনা । ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার কাজীপাড়া মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেনীর ছাত্রী পাশাপাশি রেলস্টেশনের চত্বরে পথের পাশে পিঠা বিক্রেতা হিসেবেই তার দ্বৈত পরিচয়।প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ, স্কুল শেষে কর্ম ক্ষেত্রে ঘাম ঝড়ানো শ্রম। বিনিময়ে যে আয় হয় তা দিয়ে দিয়ে চলে কোমলমতি শিশুটির পরিবারের অন্নের যোগান এবং নিজের লেখাপড়ার খরচ।
দোলেনাকে দেখা যায় প্রতিদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশনের চত্বরে রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নীচে পিঠা বিক্রির দোকানে। স্কুল থেকে ফিরে ড্রেস খোলার ফুরসৎ পায় না অধিকাংশ সময়। বই খাতা থাকে পাশে, মাথার উপর খোলা আকাশের সূর্যের তাপ ও লাড়কি চূলার আগুনের উত্তাপের মাঝে পিঠা তেরী আর বিক্রি করে কাটে তার সময়। কচি হাতে নিপুনভাবে নানা দেশী পিঠা রুটি তৈরীতে সিদ্ধহস্ত। মাটির দুটি চুলা, লাকড়ি আগুন, ধোঁয়া ,হাড়ি পাতিল খুন্তি,চিতল, ভাঁপা, চই, কুলি পিঠা তৈরীর চাউলের গুড়ি,তৈরী নানা পিঠা শুটকি, শর্ষে ভর্তা, একটি ভাঙ্গা বেঞ্চ, কাঠের ফ্রেমে কাঁচ বসানো বাক্সে সাজানো পিঠা নিয়েই তার দোকানের পসরা সাজানো। নিম্ন আয়ের ক্রেতাদের ভীর থাকে এই দোকানে। স্কুল শেষে পিঠা তৈরী, বিক্রি সময় সুযোগে স্কুলের পড়া এই হলো দোলনের প্রতিদিনের রুটিন। কর্ম ক্ষেত্রে খোলা আকাশের নীচে সে ছায়াহীন রোদ বৃষ্টি ভেজা সংগ্রামী জীবন যোদ্ধা। পারিবারিক জীবনেও তেমন ছায়া আদর ভালবাসা মিলেনি তার। পিতা কিশোর গঞ্জের বায়োজিদপুরের আইয়ূব আলীর মৃত্যু হয় তার জন্মের পূর্বেই, মা হেলেনার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়,তাই শিশূ কাল থেকেই পিতার আদর আর মায়ের ভালবাসার কোল মিলেনি তার। এতিম দোলেনা আর তার বোন অন্তরা বেড়ে উঠে নানা নানীর আশ্রয়ে। নানী জুবেলা খাতুনের কোলে চড়েই পিঠার দোকানে প্রথম আসে সে। বুঝে উঠে পর এই দোকানে নানীকে সহায়তা শুরু করে। এক পর্যায়ে নানী এবং নিজের আগ্রহেই ভর্তি হয় স্কুলে। স্কুলে যায় প্রতিদিন বাকী সময় কাটে নানীর সাথে পিঠার দোকানে। স্টেশনের পাশে উত্তর মৌড়াইলের একটি ছোট্ট ঘরে অস্থায়ী বসতি তাদের।
রেল স্টেশন চত্বরে স্কুল ড্রেস পড়া অবস্থায় দোলেনার সাথে দেখা হলে সে জানায় , “স্কুল থাইক্যা আইছি, অহন পিঠা বানামু। পিঠা না বানাইলে খামু কি ? ”লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করে সে জানায়, লেহাপড়া না করলে শিক্ষা পামু ক্যামনে? লেহাপড়া আমার ভালা লাগে, তাই লেহাপড়া করি,লেহাপড়া করলে অনেক কিছু জানন যা। আমি লেহাপড়া কইরা বড় অইতে চাই”। স্বল্প ভাষী দোলন কাজের ব্যস্ততায় তেমন বেশী কিছু আগ্রহী না।দোলন একসময় চলে যায় তার বাসায়। কথা হয় তার নানী জুবেলা খাতুন এর সাথে, তিনি জানান, কিশোর গঞ্জে তাদের বাড়ি, আয় রোজগারের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকেন, তার স্বামী নূরুল ইসলামের বয়স হয়ে গেছে, তেমন রোজগার নেই, স্বামী আর পিতৃহারা মায়ের কোল ছাড়া দুই নাতনী নিয়েই তার সংসার।পিঠা বিক্রির ২ থেকে ৩শ টাকা লাভ দিয়েই হয় তাদের জীবিকা নির্বাহ। ছোটবেলা থেকে দোলেনার লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে স্কুলে ভর্তি করেছে। দোলেনা লেখাপড়া মনোযোগ দিয়েই করে এবং পিঠার দোকানে তাকে নিয়মিত সহযোগিতা করে। কথার ফাঁকে একসময় কেঁদে ফেলেন পড়ন্ত বয়সী জুবেলা খাতুন, বলতে থাকেন “নাতিনের লেহাপড়ার ইচ্চা শখ, এই লাইগ্যা স্কুলে ভত্তি করছি,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি জানান, “পেডের খাওন জুটে না তবু নাতনীর শখ মিঠাইতাছি,কদিন এমুন চলবো তা জানি না। বাফ মরা আর মায়ের কাল ছাড়া নাতিন আমার লেহাপড়ায় যেমুন ভালা তেমুন কাজেও খুব ভালা। চোখ ভরা জলে দুহাত তুলে তিনি বলেন , আফনেরা আমার নাতনীর জন্য দোআ কইরেন।
লেখক : সিনিয়র সহ সভাপতি , ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব , সম্পাদক নতুন মাত্রা।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com