ধন মিয়ার চার ছেলে প্রবাসে থাকেন। বাড়িতে পাকা ঘর। বাড়িতে দোতলা ঘর থাকা শওকত ওসমান ধানের ব্যবসা করেন। বাড়িতে পাকা ভবন থাকা বাচ্চু মিয়ার তিন ছেলে প্রবাসে থাকে। ধন মিয়া ৭নং ওয়ার্ডে এবং শওকত ওসমান ও বাচ্চু মিয়া থাকেন ১২ নং ওয়ার্ডে। অবশ্য এখানেই শেষ নয়। নামের তালিকায় রয়েছেন ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের দুই ভাই। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘স্বচ্ছল’! আছেন আওয়ামী লীগ নেতা ও চালের ডিলার মো. শাহ আলমের ভাই, স্ত্রী, শ্যালক, মেয়ে পরিবারের ১২ সদস্য। ডিলারের রয়েছে বহুতল ভবন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমন ৮৪ জন ‘বড়লোক’ এর নাম উঠেছে ওএমএস’র তালিকায়। এছাড়া স্বামীর পাশাপাশি স্ত্রী, একই নাম দুইবার, চাল নিতে আগ্রহী নন এমন নামও উঠানো হয়। ওই নামের সংখ্যা সাত। মূলত কাউন্সিলর, ডিলারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সখ্যতার সুযোগে এসব নাম উঠেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডে মোট নয় হাজার ছয়শ’ জন ওমমএস’র সুবিধা পাচ্ছেন। ওমমএস’র কার্ডধারিরা ১০ টাকা কেজি দরে চাল কিনতে পারেন। মূলত সমাজের হতদরিদ্রদের জন্য সরকার এ ধরণের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।
তালিকা তৈরিতে অনিয়ম নিয়ে গত সোমবার হওয়ার জেলা ওএমএস কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক হায়াত-উদ-দৌঁলা খান ইতিমধ্যেই ডিলার মো. শাহ আলমকে কেন তাঁর ডিলারশিপ বাতিল করা হবে না জানতে চেয়ে নোটিশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সামর্থবান ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া এবং তালিকা তৈরিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে পৌর মেয়র নায়ার কবিরকে চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসক। চিঠির সঙ্গে ৯১ জনের নামের তালিকাও জুড়ে দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তালিকা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হয়েছে ৭, ১০ ও ১২ নং ওয়ার্ডে। এছাড়া ২, ৩, ৪, ৫, ৮, ৯ নং ওয়ার্ডে কিছু অনিয়ম পাওয়া যায়। তবে ১, ৬ ও ১১ নং ওয়ার্ডে এখন পর্যন্ত কোনো অনিয়ম পাওয়া যায় নি।
সবচেয়ে আলোচিত ১০নং ওয়ার্ডের তালিকায় জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং ওএমএস ডিলার মো. শাহ আলমের পরিবার ও বেশ কয়েকজন স্বজনের নাম উঠেছে ওএমএস তালিকায়। এর মধ্যে তালিকার ১২ নম্বরে মেয়ে আফরোজা ও ১৬ নম্বরে রয়েছে স্ত্রী মোছাম্মৎ মমতাজ আলমের নাম। এছাড়াও শাহ আলমের তিন ভাই-বোন মো. সেলিম (পরিবহন শ্রমিক নেতা), মো. আলমগীর ও শামসুন্নাহারের নাম রয়েছে ৮, ৯ ও ২৭ নম্বর ক্রমিকে। আরেক ভাই খোরশেদ মিয়ার ছেলে প্রবাসী নাছিরের নাম রয়েছে সাত নম্বরে। তিন নম্বরে রয়েছে শ্যালক তাজুল ইসলাম ও ১৩ নম্বরে শ্যালক শফিকুল ইসলামের নাম। আরেক শ্যালকের স্ত্রী জান্নাতুল ইসলামের নাম রয়েছে ১০ নম্বরে। শাহ আলমের বোনের তিন দেবর মতিউর রহমান, মাহবুবুর রহমান, লুৎফুর রহমানের নাম রয়েছে ৭২, ৭৩ ও ৭৪ নম্বরে।
ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকবুল হোসেনের ভাই গোলাম রাব্বানী, মো. হানিফ ও মো. আরিফের নামও রয়েছে তালিকায়। হানিফ ও গোলাম রাব্বানী পেঁয়াজ রসুন ব্যবসায়ি এবং আরেক ভাই আরিফ কাঁচামালের ব্যবসায়ি। এছাড়া ওই ওয়ার্ডের হাসেন আল-মামুন, বশির মিয়া, সেলিনা বেগম, মো. ইকবাল, মিনারা বেগমের নাম উঠেছে তালিকায় যারা স্থানীয়ভাবে স্বচ্ছল হিসেবে পরিচিত। ওই ওয়ার্ডের ২২ জনকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার কথা বলেছে ওএমএস কমিটি।
৭ নং ওয়ার্ডের ২৪ জনের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে বাচ্চু মিয়া, আব্দুল হেকিম, স্মৃতি বেগম, শফিক মিয়া, কবির মৃধা, এরফানুল বারী, বজলু মিয়া, রোকসানা বেগম, ধন মিয়া, আরস মিয়া, শামীম আহমেদ, শামছুল হক, বরীন্দ্র বর্মণ, কামাল মিয়া, মাধব কর্মকার, শরীফা, জালাল, জামান, নাজির মিয়া, হোসেন মিয়া, নূরুল আলম, পল্টু ঘোষ, রতন রায়, সাদেক মিয়ার নাম রয়েছে। যাদেরকে স্বচ্ছল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দুই ছেলে প্রবাসে থাকা নাজির মিয়া দুই কোটি টাকার মালিক, আর্থিক স্বচ্ছল বজলু মিয়ার এক ছেলে প্রবাসী ও এক ছেলে ইতালি, কবির মিয়া শহরের বড় কাপড় ব্যবসায়ি, নূরুল আলমের দোতলা বাড়ির তৃতীয় তলার কাজ চলমান বলে নিশ্চিত হয়েছে ওই কমিটি।
১২ নং ওয়ার্ডের তালিকার ১৯ নম্বরে রয়েছে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হারুণ অর রশিদ, ৪৮৮ নম্বরে রয়েছে জেলা কৃষক লীগের সাধারন সম্পাদক ফরিদ উদ্দিন দুলালের নাম। ঠাঁয় হয়েছে প্রতি বছর প্রচুর ধান পাওয়া সাড়ে সাত একর জমির মালিক কানাই ঋষির নাম। চাল নিতে আগ্রহী নন স্বচ্ছল ব্যক্তি নাদির মিয়ার নামও আছে তালিকায়। এছাড়া মজিবুর রহমান, রহত আলী ভূঁইয়া, নকুল কুমার সাহা, বাচ্চু মিয়া, মৃণাল কান্তি রায়, নগেন্দ্র ঋষি, নারায়ণ ঋষি, অপূর্ব সাহা, আলী আজম, শেখ আলী আজহার, রাকিব ভূঁইয়া, সাহিদ ভূঁইয়া, শওকত ওসমান, নাছিমা আক্তারের নাম রয়েছে যারা স্থানীয়ভাবে স্বচ্ছল হিসেবেই পরিচিত। এছাড়া ৩৬৭ ও ৪৬৮ নং ক্রমিকে একই ব্যক্তির (শুভ সাহা) নাম রয়েছে। ওই ওয়ার্ড থেকে ১৯ জনের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে।
পৌরসভার কাছে জেলা প্রশাসকের পাঠানো চিঠিতে ২নং ওয়ার্ডের সাতজনের নাম বাদ দিতে বলা হয়েছে। মুজিবুর রহমান, অরূপ চন্দ্র মোদক, নারায়ণ বণিক, ইন্দ্রজিৎ বণিক, বিশ্বজিৎ পালের নাম। তাঁদের প্রত্যেকেরই রয়েছে বহুতল ভবন। এছাড়া একই সঙ্গে স্বামী সুবীর নাথ ও স্ত্রী স্বপ্না রানীর নাম উঠানোয় বাদ দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে ৩নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবু তাহেরের ছেলে আবু বাকের পাঁচতলা ভবনের মালিক হলেও তাঁর নাম রয়েছে ওএমএস তালিকায়। ৯ নং ওয়ার্ডের তালিকায় জহির আহমেদ খান ও শাহাদাৎ হোসেন খান নামে দুই স্বচ্ছল ব্যক্তির নাম রয়েছে। নাছিমা চৌধুরী ও আবু জামাল ভূঁইয়া নামে দ্বিতল ভবনের মালিক ওই দুইজনের নাম রয়েছে ৫নং ওয়ার্ডের তালিকায়।
ডিসি অফিসের কর্মচারি ভাড়ায় বসবাস করা কাজল চন্দ্র বিশ্বাসের নাম আছে ৪নং ওয়ার্ডের তালিকায়। ওই ওয়ার্ডের সুহেদা বেগম, কুসুম সরকার, মালতী দেবের নাম তালিকায় থাকলেও তাঁদেরকে খোঁজে পাওয়া যায় নি। শামীমা আক্তারের নাম উঠেছে দুইবার। এছাড়া তিনতলা বাড়ির মালিক সুধীর দাস, বেসরকারি চাকুরে সৈকত করের নাম রয়েছে তালিকায়। টিনশেড বাড়ির মালিক সহিদুর রহমান চাল নিতে আগ্রহী না হলেও তাঁর নাম রয়েছে তালিকায়।
দোতলা বাড়ি আছে এমন পাঁচজনের নাম উঠেছে ৮নং ওয়ার্ডের তালিকায়। তাঁরা হলেন, কিতাব আলী, জীবন সাহা, নেরোজ আলী, সাকিল ও উপল মালাকার। এছাড়া ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা আব্দুর রউফের দুই ছেলে প্রবাসে থাকলেও ওমমএস’র তালিকায় নাম রয়েছে।
জেলা লীগ নেতা ও জেলা চেম্বার অব কমার্স ইন্ড্রাস্ট্রির পরিচালক মো. শাহ আলম সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘স্বচ্ছভাবে চলতে গেলে গরীব থাকতে হয়। আমিও গরীব। পৈতৃক টাকায় বিল্ডিং করেছি। এখন আমি ২২ লাখ টাকা ঋণ আছি। আমার মেয়ের জামাইও বেকার। এমন চিন্তা করেই নাম দিয়েছি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে দেখুক।’
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী বলেন, ‘ওএমএস কার্ডের তালিকায় সামর্থ্যবানদের নাম ওঠার বিষয়টি জেলা ওএমএস কমিটির সভায় আলোচনা হয়েছে। ওই সভায় ৯১ জন সামর্থ্যবানকে চিহ্নিত করে তাদেরকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন জেলা প্রশাসক
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com