২০২০ সাল। ৭ই মার্চ আমার মেয়ে কাব্য নাচ পারফর্ম করে ইউনিভার্সিটিতে ইন্টারন্যাশনাল নাইটে। রিহার্সাল, প্রোগ্রাম অ্যারেন্জ আর ক্লাস মিলিয়ে এই কয়দিন শুধু রাত্রে ঘুমানোর জন্য আমার মেয়ে ঘরে ফিরেছে। তার নাচের ভিডিও সে আমাদের পাঠায়। সেই সাথে জানায় তার রুমমেট নেহার ক্যানাডা থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্তের সংবাদ।
নেহা কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘরের চাবি টেবিলের উপর রেখে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। নেহা তার রুমে পরিত্যাক্ত অবস্থায় রেখে গেছে একটি সোফা, একটি টেবিল ফ্যান আর একটি ল্যাম্প। সেগুলি কাব্য ভিডিও কলে দেখায় আমাকে।
কাব্যের রুমমেট নেহা মফঃস্বল থেকে ক্যানাডায় গিয়েছিলো। চলনে বলনে আচরণে এই মেয়েটি খুব সরল, বোকা এবং অগুছালো। নিজেকে সে এই পরিবেশে মানিয়ে নেবার উপযুক্ত ছিলো না মোটেও। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে সে ছিলো চরম উদাসীন। লেখাপড়াতেও সে তেমন মন বসাতে পারছিলো না।
নিতান্তই নিরীহ এই মেয়েটি এতদুর যে কেন এসেছিলো সেই প্রশ্ন মনে আসতো প্রায়শই। নেহা বেশ অসুস্থ থাকতো। কাব্য তাকে বেশ কয়েকবার এসিডিটির সমস্যার কারণে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে। কয়েকমাস ধরে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে সে একসময় দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
এদিকে ইটালী থেকে দেশে ফিরে আসতে থাকে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। মানবিক কারণে তাদেরকে দেশে আনার ব্যাপারে সরকার সদয় ছিলো বলে আমার ধারণা। কিন্তু তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিমানবন্দরে তেমন সতর্কতা অবলম্বন করা হয় নাই।
তাদের হোম কোয়ারান্টাইনের ব্যাপারেও সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয় নাই। মনে করা হচ্ছিলো যে আবহাওয়ার কারণে এদেশে করোনা বিস্তারের সম্ভাবনা কম। সেই শৈথিল্যের সুযোগে কমিউনিটি টান্সমিশনের আতংক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয় সর্বত্র।
এক্ষেত্রে আমরা যেমন প্রবাসীদের ফিরে আসার অধিকারকে ছোট করে দেখতে পারি না তেমনি জনগনের উৎকন্ঠার ব্যাপারগুলিও খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। সচেতনতার অভাবে এই সময়ে আক্রান্ত মানুষগুলি মিশে যায় সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায়।
” মা, নেহা মারা গেছে”। ১৪ই মার্চ সকালে এভাবেই নেহার মৃত্যু সংবাদ জানায় কাব্য। মারা গিয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে। কারণ এখনো অজ্ঞাত। নেহার এক বন্ধু কাব্যকে জানিয়েছে। জানার পর থেকেই অজানা আতংকে সময় গড়াচ্ছে। জ্বর, পেটব্যথা, শ্বাসকষ্ট – এই তিন উপসর্গের সাথে শকে যাওয়ার ঘটনা।
করোনা সন্দেহে যথাযথ ম্যানেজমেন্ট হয়নি নেহার। আসল সংবাদ জানা দরকার। এদিকে প্যানিক হয়ে গেছে কাব্য। যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে ত ওরাই এখন সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে। কাব্য আমাকে নিশ্চিত করছিলো যে দেশে ফেরার আগে নেহার কোন জ্বর, কাশি বা গলাব্যথা ছিলো না। তবুও শংকা কাটে না।
সারাদিন ফোন করে পাইনি কোন তথ্য। কাব্য জেগেছিলো সারারাত ধরে। সকাল ছয়টায় ঘুমিয়েছে। আমি বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় নেহার বাবার সাথে কথা বলতে সক্ষম হই। বিভিন্ন হাসপাতালে মেয়েটিকে নেয়া হয়েছিলো। কোথাও ভর্তি রাখেনি ওকে। রাত্রে সরাসরি ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পরে চিকিৎসা শুরু করার পর খানিকটা ইম্প্রুভ করেছিলো।
কিন্তু পরদিন সকালে নার্স যখন জানতে পারে যে নেহা ক্যানাডা থেকে ফিরেছে অমনি আতংক ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত ওয়ার্ড জুড়ে। করোনা সন্দেহে অনেকটা সময় তাকে অ্যাটেন্ড করেনি কেউ। যেহেতু কারো কাছে পি পি ই ছিলো না তাই ডাক্তার বা নার্স তার কাছাকাছি যেতে ভয় পেয়েছে।
নেহার বাবা আমাকে জানায় পরে আই ডি সি আর কর্তৃক পরীক্ষা করে জানানো হয় যে সে করোনা নেগেটিভ। ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ২২ বছরের মেয়ে নেহা। ওর বাবার সাথে কথা বলছিলাম যখন লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সের শব্দ কানে আসছিলো। কি অসহায় এক মরণ এসে কেড়ে নিলো একটি মুল্যবান প্রাণ।
পরদিন অনেকগুলি জাতীয় দৈনিকে এই খবর ছাপা হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হয় সমস্ত ঘটনা। কিছু সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরা হয় বর্ননায়। বাবা মায়ের জন্য সে যে কি ভয়াবহ সংবাদ! এদিকে প্রচন্ড আত্মগ্লানিতে ভুগছে আমার মেয়েটাও। শেষ মুহুর্তে নেহা ওকে বলে কয়ে বাসা ছাড়েনি। হয়তো কোন অভিমান ছিলো মেয়েটার মনে। অথবা এতোটাই অসুস্থ ছিলো যে বলে যাবার মতন ইচ্ছা হয়নি।
নেহার ক্লাসমেটরা ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছিলো।কাব্য বেশ দিশাহারা হয়ে পড়ে এই সময়ে। একদিকে একই বাসায় বসবাস করা মানুষটির মৃত্যুসংবাদ, অন্যদিকে অজানা আতংক! পরিবারের সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সেই মুহুর্তগুলি খুব অসহনীয় ছিলো।
লেখক-ডাঃ নিবেদিতা নার্গিস
এফ.সি.পি.এস,এম.ডি
সহযোগী অধ্যাপক এবং হেড অফ ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট
জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আইচি নগর, উত্তরা, ঢাকা।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com