গতবছর ৯ই জুন আমার কোভিড ক্রিটিকাল এরিয়াতে ডিউটি শুরু। প্রথম যে পেশেনট ভর্তি হয়, পরের দিনই তার বাবা আর মাকে সে নিয়ে আসে এই হাসপাতালের আই সি ইউ তে। দুজনেই কোভিড আক্রান্ত এবং বাবার অবস্থা ক্রিটিকাল। পাশের বেডে একদিন পরেই মারা যান তার বাবা। এ যে কি অসহায় মৃত্যু! সবার মধ্যে প্রচন্ড আতংক। আল্লাহর ইচ্ছায় মা আর ছেলে সেরে উঠে কদিনের মধ্যেই।
প্রথম সপ্তাহে তিন দিনে পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে ছয় জন। পরের সপ্তাহে অফের পরে রবিবার যখন ডিউটিতে ফরে এলাম, জানতে পারি ক্রিটিকাল কেয়ার এরিয়াতে পেশেন্টের সংখ্যা বিশ। বেডের সংখ্যা চব্বিশটি। এদিন সব বেডেই রোগী ভর্তি হয় । কত অল্প সময়ে সব বেড অকুপাইড।আমি ইতোমধ্যে ডোনিং আর ডোফিং খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছি। জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ পি পি ই সরবরাহের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার। আমি কাজের জায়গায় তাই সাচ্ছন্দ্য নিয়ে মুভ করতে পারছি। আল্লাহ আমার সহায় হউন, আমীন।
সেসময়ে এক একটি খবর শুনে উদ্বিগ্ন হই। স্কয়ার, বি আর বি এবং ইমপালস হসপিটালের আই সি ইউ হেড মৃত্যুবরণ করেছেন। ল্যাব এইড হাসপাতালের একজন এনেস্থেসিওলজিস্ট মারা গেছেন। রংপুরেও একজন এনেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ জীবন দিয়েছেন। বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অধ্যাপক আর এভার কেয়ার হাসপাতালের আই সি ইউ বিশেষজ্ঞ অনেকদিন ধরে হসপিটালাইজড। এরা দুজনেই আমার অনেক ঘনিষ্ট। সেকারণে অনেক উৎকন্ঠায় ছিলাম। সি এম এইচের চিকিৎসায় বহুদিন হাই ফ্লো অক্সিজেন, প্রন ভেন্টিলেশন চিকিৎসায় বেঁচে আছেন একজন । অন্যজনও প্রচন্ড ক্রিটিকাল অবস্থায় ভর্তি থেকেছে এভার কেয়ারেই। আল্লাহ তাদের দুজন কেই সুস্থ করে তুলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আই সি ইউ হেড যিনি তার আক্রান্ত হবার খবরে বিচলিত হয়েছি। বাসায় চিকিৎসাধীন আরেকটি ডাক্তার পরিবার নিয়ে চিন্তার সীমা নাই। আমার ইয়ারমেটদের মধ্যে দুজন আক্রান্ত হলেও তাদের লক্ষ্মণ ছিলো না এবং অল্পকদিনেই নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে আলহামদুলিল্লাহ। পরিবারের মধ্যে আক্রান্ত হয়েছে ভাইয়ের শ্যালিকা কুর্মিটোলা হাসপাতালে কর্মরত গাইনি বিভাগে কর্মরত ডাক্তার আর খালাতো বোনের মেয়ে। তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়েছে বলে মনের অবস্থা খুব শোচনীয় ছিলো ওদের। দুজনেই আল্লাহর রহমতে সুস্থ এখন।
গন্ধ বুঝতে না পারার লক্ষ্মণসহ সামান্য জ্বরে ভুগেছে কাব্যর চাচাতো ভাই আর আমার মামাতো বোন। অসুস্থ হয়েছেন এম এম সির আরেক ডাক্তার বড়ভাই । মুগদা জেনারেল হাসপাতালে অক্সিজেন সাপোর্ট লেগেছে উনার। ভাইটি এখন অনেকটা সুস্থ। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু এবং তার মা সুস্থ হয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ। ওরা সেরে না উঠতেই আক্রান্ত হন আমাদের অতিপ্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষী পেন্সিলের একজন সক্রিয় সদস্য । ক্যাডেট কলেজের ছোটবোনের বর হলেও উনি এখন আমারই ভাই। আমার সমস্ত পরামর্শ গ্রহন করে মনোবল অক্ষুণ্ণ রেখে উনি সুস্থ হয়ে উঠছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
২০২০ সালে ১৫ ই জুন প্রথম আমি স্কাই পে মিটিং করি জাপানিজদের সাথে। আমার ইনপুটে তারা সন্তুষ্ট। আমিও তাদের দেয়া আশ্বাস পেয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। স্টাফদের স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের কনসার্ন আমাকে মুগ্ধতা দিয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু স্টেপস নিয়েছি। চুল ছেটে ফেলেছি বয়কাট করে। হিজাব পরি বলে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হয়েছে। পরছি সিনথেটিক ফতুয়া আর সাধারন পালাজ্জো। এই পোশাক নির্বাচনের কারণ হলো সহজে ধোয়া যাচ্ছে এবং ইস্ত্রি করার ঝামেলা নাই।
যখন পি পি ই খুলি তখন পুরা শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার হয়। দিনে অন্ততঃ দুবার গোসল করি। পি পি ই পরতে হবে বলে একবার। খুলার পর নিজেকে পরিচ্ছন্ন করতে আরেকবার। এভাবেই নিজেকে ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখি। সবমিলিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করছি নতুন কর্মস্থল।
-লেখক-ডাঃ নিবেদিতা নার্গিস
এফ.সি.পি.এস,এম.ডি
সহযোগী অধ্যাপক এবং হেড অফ ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট
জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আইচি নগর, উত্তরা, ঢাকা।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com