বিশ্বজিৎ পাল বাবু:
উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে ঢুকতেই ডান দিকের পথ ধরে ১০০ গজের মতো যেতেই ‘অপরাজিতা। রোদের তীব্রতা ‘অপরাজিতাকে’স্পর্শ করতে পারছে না। গাছগাছালির পরিপূর্ণতায় প্রশান্তির ছায়া। গোলাকৃতির ‘আড্ডাখানা আর দোলনায় পরিবেশটাও বেশ।
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সরকারি যে বাসভবনটিতে থাকেন সেটির নাম ‘অপরাজিতা। যেখানে রচিত হয়েছে ইউএনও দম্পতির করোনা যুদ্ধ জয়ের গল্প। যোদ্ধা ইউএনও তাহমিনা আক্তার রেইনা। পর পর দুইবার করোনার রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ। দ্বিতীয় দফায় তাঁর স্বামীর করোনা রিপোর্টও নেগেটিভ। তাঁদের তিন বছর বয়সি একমাত্র পুত্র সন্তান রইফিকে ঘিরে ‘অপরাজিতায়’ গড়ে উঠে হৃদয়ছোঁয়া গল্প।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে অপরাজিতায় যাওয়া। এক সহকর্মীকে নিয়ে যাওয়ার পথে দেখা হওয়া উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারি রিপনের সহযোগিতায় খবর পৌঁছানো হয় ইউএনওর কাছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই আসেন ইউএনও। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কথা হয় আধা ঘন্টার মতো।
ইউএনও তাহমিনা আক্তার রেইনা জানালেন, তিনি এখন পুরোপুরিই সুস্থ আছেন। তাঁর স্বামীর মাঝেও এখন উপসর্গ নেই। করোনা পরীক্ষায় আজ রোববার দ্বিতীয়বারও তাঁর নেগেটিভ এসেছে। যে কারণে একমাত্র সন্তান রইফিকে দেখভাল করতে পারছেন।
করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই আইনজীবী স্বামী রাশেদুল ইসলাম পেশাগত কাজ ফেলে চলে আসেন স্ত্রীর কর্মস্থলে। উদ্দেশ্য, সার্বিক পরিস্থিতিতে স্ত্রীর দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় সংসারকে গুছিয়ে রাখা। সন্তানকে নিয়ে অনেকটা ‘হোম কোয়ারেন্টিন’ পালন করেছেন রাশেদুল ইসলাম। তবে তাহমিনা আক্তার রেইনাকে ছুটে চলতে হয়েছে রাত বিরাত।
২৬ জুন করোনা পজেটিভ আসার খবরে যেন মাথায় বাজ পড়ে তাহমিনা আক্তারের। বিশেষ করে তিন বছর বয়সি সন্তানকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। সন্তানকে কাছ আসতে না দেয়ার যন্ত্রণা তাঁকে বেশ পোড়ায়। মাকে কাছে পেতে করোনা কি সেটা বুঝতে না পারা সন্তানের চোখের জলে মাকে করে তুলে আরো পাষাণ! সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করেই তিনি অনেক বুঝিয়ে দূরে রেখেছেন। ১ জুলাই স্বামী রাশেদুল ইসলামেরও করোনা পজেটিভ আসে। তবে এরই মধ্যে নিজের নেগেটিভ আসায় সন্তানকে কাছে টেনে নিয়েছেন।
কথা বলার ফাঁকেই ছুটে আসে রইফি। একটি সাইকেল নিয়ে ঘরেই ঘুরছিলো সে। আবার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে ছুটে আসে। করোনায় এ পৃথিবীর করুণ দশার কথা হয়তো ছুঁয়ে যায়নি তাঁকে। আর রইফি মায়ের বড় শান্তি যে তাঁর ছেলেকে এখনো করোনা স্পর্শ করেনি।
ইউএনও তাহমিনা আক্তার রেইনা বলেন, ‘আমার গাড়ির চালক ছোটন যেদিন অসুস্থবোধ করে সেদিনই আমারও সমস্যা হয়। নানা উপসর্গ দেখা দেয়। উপসর্গ বুঝতে পেরে নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেই। পরদিনই নমুনা দিলে রাতে পজেটিভ আসে। শুরুতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বিশেষ করে ছোট্ট সন্তানের কথা চিন্তা করে খারাপ লাগে। আস্তে আস্তে মানিয়ে নেই। চিকিৎসাও চালাই নিয়ম মেনে। খুব কম সময়ের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আজ রোববার দ্বিতীয়বারের মত নমুনা রিপোর্ট আসায় পুরোপুরি সুস্থ অনুভব করছি। একই সাথে স্বামীর করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় তার পুরো পরিবার ভারমুক্ত হয়েছেন বলেও জানান।
তিনি বলেন, ‘আমার করোনা আক্রান্তের খবরে সহকর্মী পদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে আখাউড়ার মানুষ যেভাবে দোয়া করেছেন সেটা কল্পনারও বাইরে, ভুলার নয়। সবার দোয়ায় আমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমি খুব শিগগিরই আবার মানুষের সেবায় নামতে পারবো বলে বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে সমস্যা কিংবা নানা সম্মুখীন হতেই হবে। দায়িত্বশীল আরো অনেকেই হয়তো আক্রান্ত হবেন। কিন্তু আমাদেরকে পিছিয়ে পড়লে চলবে না। জাতির এই দু:সময়ে নিজ দায়িত্বটা যতটুকু সম্ভব পালন করতে হবে।’তিনি খুব দ্রুত নিজ দায়িত্বে ফিরছেন বলেও জানান।
উল্লেখ্য দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুতেই মানুষকে মাইক হাতে সচেতন করা, আখাউড়ায় আক্রান্তদের হাসপাতালে পাঠানো, হোম কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন নিশ্চিত করা, করোনায় মৃতদের দাফন-সৎকার, মোবাইলে অসহায় কর্মহীন মানুষের ফোন পেয়ে গোপনে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়াসহ নানা ধরণের কাজ করে করোনাকালে মানবিকতার এক অনন্য নজির স্থাপনকারী করেন আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার রেইনা। এসব নানামুখী কাজ করে তিনি আখাউড়াবাসীর মনে স্থান করে নেন। শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তার আরোগ্য কামনা করে হাজারো মানুষ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। নিয়মিত খোজখবরও নিয়েছে লোকজন।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com