ত্রিপুরারাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেছেন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বিজেপি জোট বেঁধেছে। যারা ত্রিপুরারাজ্য ভাগের দাবি করছে তাদের সঙ্গে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা মিটিং করে সমঝোতা করেছেন। ত্রিপুরায় যারা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে চলেগেছে, তাঁরাই এখন বিজেপিতে। এখন তারা খোলাখুলি আইপিএফটির সঙ্গে জোট করেছে। অবরোধ অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ত্রিপুরার মানুষ এসব দেখছেন, শান্তি সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ত্রিপুরাবাসীর কাছে আমরা আবেদন করবো। আমরা নিশ্চিত ত্রিপুরার মানুষ এর উপযুক্ত জবাব ওদের দেবেন। নির্বাচন ঘোষণার পর কলকাতার গণশক্তির সাথে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তিনি এই সব কথা বলেছেন। গণশক্তিকে দেয়া স্বাক্ষাৎকারটি নিচে তুলে ধরা হল।
প্রশ্ন: বহু বছর পরে আমরা আবার ত্রিপুরা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবির সংবাদ পাচ্ছি। সত্যিই কি সেখানে বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে? এই অস্থিরতা কি ত্রিপুরার আর্থ-সামাজিক সমস্যা উঠে আসছে? নাকি রাজনৈতিকভাবে নির্মিত হচ্ছে?
মানিক সরকার: প্রথম কথাই আমি বলবো যে, ত্রিপুরায় উপজাতি ও বাঙালিদের মধ্যে বিরোধের প্রচার সত্য নয়। এটা ঠিক যে, উপজাতিদের মধ্যে একটা ছোট্ট অংশ অনুপজাতি অংশের সঙ্গে বিভাজনের লক্ষ্যে ত্রিপুরা ভাগের স্লোগান তুলেছে। এই স্লোগানের ভিত্তিতে তারা আন্দোলনের নানা কর্মসূচিও চালাচ্ছে। যেমন জাতীয় সড়ক ত্রিপুরার লাইফ লাইন, সেই জাতীয় সড়ককে অনির্দিষ্টকালীন অবরোধ করা হয়েছিল। বহু সংগ্রাম করে ত্রিপুরায় রেল এসেছে। সেই রেলপথ অবরোধ করলে কী সমস্যা দেখা দিতে পারে তা সবাই বোঝে। উপজাতিদের সঙ্গে অনুপজাতি মানুষদের বিরোধ বাধানোর লক্ষ্য নিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী আই পি এফ টি সেটাই করছে। জনগণের গণতান্ত্রিক ঐক্য যা ত্রিপুরায় রয়েছে সেটা নষ্ট করা গেলে শান্তি উন্নয়ন ভঙ্গ করা যাবে। এরকম একটা লন্ডভন্ড পরিস্থিতি তৈরিই তাদের লক্ষ্য। এর আগেও তারা স্বাধীন ত্রিপুরার স্লোগান দিয়েছিল, বিদেশি বিতাড়নের স্লোগান দিয়েছিল। নতুন স্লোগানে পুরানো কৌশলকে তারা কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ত্রিপুরার মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে আগেও এর মোকাবিলা করেছে, এখনও করছে। আই পি এফ টি উপজাতিদের সংগঠন হলেও তাদের গণভিত্তি উপজাতিদের মধ্যেও নেই। তারা অতি ক্ষুদ্র শক্তি। কিন্তু এদের সঙ্গেই বি জে পি জোট বেঁধেছে। ওরা যখন সড়ক অবরোধ করেছে এরা তখন সড়ক অবরোধ তোলার দাবি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেছে। ওরা চাইছিল, আমরা জোর করে পুলিশ দিয়ে ঘেরাও তুলে দিই। তাহলে প্রচার করতে পারতো, সরকার উপজাতিদের প্রতি নরম আর বাঙালিদের বিরোধী। উভয়পক্ষ মিলেমিশে এভাবেই চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয়ের ঠিক আগে আমরাও নৈরাজ্য সৃষ্টির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখেছি। ত্রিপুরার বামফ্রন্ট এবং বামফ্রন্ট সরকার কি এ বিষয়ে সতর্ক? আপনারা কি রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে এর মোকাবিলা করতে পারছেন?
মানিক সরকার: আমরা প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে মানুষের কাছে এই বিভাজনের উদ্দেশ্যকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছি। এটা ওদের অবরোধ কর্মসূচির আগে থেকেই করছি। প্রশাসনিকভাবে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছি, আমাদের পার্টি ও বামফ্রন্টের পক্ষ থেকেও করছি। সেই কারণেই এখনও পর্যন্ত বিভাজনের উদ্দেশ্যে ওরা সফল হতে পারেনি। বহু প্ররোচনা দেওয়া সত্ত্বেও আমাদের সরকার এবং ত্রিপুরার মানুষ ওদের ফাঁদে পা দেননি। ত্রিপুরার মানুষ ওদের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারছেন। সেইজন্যই উপজাতির মানুষ আই পি এফ টি-র রাজ্যভাগের স্লোগানে সাড়া দেয়নি, আবার অনুপজাতি মানুষের মনে উপজাতিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষও জাগাতে পারেনি।
প্রশ্ন: ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়ে গেছে। এবারের নির্বাচনে কি এর প্রভাব পড়তে পারে?
মানিক সরকার: বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে নির্বাচনে বি জে পি জোট বেঁধেছে। ফলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বেই। আমরা মানুষকে বলবো, যারা রাজ্যভাগের দাবি করছে তাদের সঙ্গে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতারা মিটিং করে সমঝোতায় গিয়েছেন। ত্রিপুরায় যারা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে চলে গিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন বিজেপিতে। এখন তারা খোলাখুলি আই পি এফ টি-র সঙ্গে জোট করেছে। অবরোধ অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। ত্রিপুরার মানুষ এসব দেখছেন, শান্তি সম্প্রীতি ও উন্নয়নের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য ত্রিপুরাবাসীর কাছে আমরা আবেদন করবো। আমরা নিশ্চিত ত্রিপুরার মানুষ এর উপযুক্ত জবাব ওদের দেবেন।
প্রশ্ন: বিচ্ছিন্নতাবাদের মতো সমস্যার সমাধানের জন্য রাজ্য সরকারগুলির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন। আপনারা কি ত্রিপুরায় মোদী সরকারের থেকে সেরকম সাড়া পাচ্ছেন?
মানিক সরকার: সহযোগিতা? ওরা আগুনে ঘি ঢালার ভূমিকা নিয়েছে। আর এস এস চালিত বি জে পি-র সঙ্গে এখন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দহরম-মহরম। জাতীয় সড়ক অবরোধের সময় গ্রামে গ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছে এরাই। আই পি এফ টি-র লোকেরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মন্ত্রীর সঙ্গে পরপর তিনবার মিটিং করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেছে। এরপরে বি জে পি-র সঙ্গে তাদের নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছে। আলাদা রাজ্যের দাবিদাররা নিজেরাই লিফলেট দিয়ে দাবি করেছে যে, কেন্দ্রের সঙ্গে তারা আলোচনা করেছে। ভালো কথা। আমি সেই সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, আপনারা যদি মনে করেন তাহলে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ডাকছেন না কেন? আমরা সরকার থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেবো। কিন্তু আমাদের অবস্থান আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি। আমরা ত্রিপুরাকে ভাগ হতে দেবো না। বিধানসভায় একটি বেসরকারি প্রস্তাবে আলোচনার সময় আমি সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, রাজ্য ভাগের পক্ষে আমরা নই। ত্রিপাক্ষিক বৈঠক হলেও তাই বলবো। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের অবস্থান স্পষ্ট করুক। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তরেরও তো দায়িত্ব জাতীয় সড়ক অবরোধের মতো অচলাবস্থা দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া। আমি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যেদিন একথা বললাম, তার পরের দিনই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও হলো। মিটিং আর হলো না। এসব থেকে পরিষ্কার যে, কেন্দ্রীয় সরকার ত্রিপুরায় এইসব ঘটনাই দেখতে চাইছে।
প্রশ্ন: ত্রিপুরায় বামপন্থীরা দীর্ঘদিন বহু সন্ত্রাস আক্রমণের মোকাবিলা করেছেন। কিন্তু এবারে বি জে পি-আর এস এস-র চ্যালেঞ্জকে কি তার চেয়েও অনেক কঠিন বলে মনে করছেন? নাকি কেবল নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন?
মানিক সরকার: রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোনও একজায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিস্থিতি পালটাচ্ছে, জাতীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়ছে। জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রভাবও আঞ্চলিক স্তরে এবং রাজ্যে নিশ্চয়ই পড়ছে। ত্রিপুরাতেও পড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি নতুন করে যেমন যেমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তার মোকাবিলায় সরকার এবং আমাদের পার্টিকে প্রস্তুত করতে। বামফ্রন্ট এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিকে, শ্রেণি এবং গণআন্দোলনের সংগঠনগুলিকে সেই অনুসারে প্রস্তুত করতে। এগিয়ে চলতে গেলে এছাড়া তো পথ নেই।
প্রশ্ন: সরকার পরিচালনায় অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা পাচ্ছেন কেন্দ্রের কাছ থেকে?
মানিক সরকার: মোদী সরকার আসার পর থেকে ত্রিপুরা কার্যত অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়েছে। পরিকল্পনা কমিশন তুলে দিয়ে নীতি কমিশন করায় উত্তর পূর্ব ভারতের সব রাজ্যই সমস্যায় পড়েছে। বছরে আমাদের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বন্ধ হয়ে গেছে। ত্রিপুরার মতো ছোট রাজ্যের পক্ষে এটা গুরুতর সমস্যা। আমরা গ্রামের গরিব মানুষকে ঘর দেওয়ায় দেশের মধ্যে একনম্বর। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পে দ্বিতীয় দফার টাকা দিচ্ছে না। রেগার মতো কর্মসূচিতে ত্রিপুরা একনম্বর। কিন্তু তারও টাকা পাচ্ছি না। আন্দোলন করে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছি, কিন্তু এখন তার উন্নয়ন বন্ধ হয়ে গেছে। ওরা আমাদের কাজে খুঁত পাচ্ছে না। তবুও টাকা আটকে দিচ্ছে। কেন্দ্রের মন্ত্রীরা এসে সব দেখে রাজ্যের অফিসারদের সঙ্গে মিটিং করে ভালো ভালো কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরে বি জে পি-র দলীয় অফিসে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে উলটো কথা বলছে। ত্রিপুরার আর্থিক সম্পদ কম, তা সত্ত্বেও আমরা মানুষের স্বার্থে মাথা নিচু করিনি, উন্নয়নের কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: নতুন বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হলে ত্রিপুরার মানুষের জন্য তার মুখ্য কর্মসূচি কী হবে?
মানিক সরকার: এটা বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইশ্তেহারে ঘোষণা করা হবে। তবে আমি কেবল এটুকু বলতে পারি যে আমরা কোনও ‘জুমলা’ দিতে পারবো না। যা করতে পারবো না তেমন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমাদের মূল লক্ষ্য দারিদ্র কমিয়ে মানুষের জীবনমান উন্নত করা। যদিও জাতীয় নীতি ছাড়া দারিদ্র দূরীকরণ সম্ভব নয়, কিন্তু দারিদ্র কমানোর লক্ষ্যে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবো। আর সেটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের যাবতীয় কর্মসূচি নেওয়া হবে। এর জন্যই শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্য চাই। না হলে উন্নয়নের কর্মসূচি রূপায়িত হবে কী করে! উন্নয়ন আর শান্তি, দুটোই একে অপরের ওপরে নির্ভরশীল। মানুষের পেটে খিদে থাকলে শান্তি থাকে না। আবার শান্তি না থাকলে দারিদ্র দূরীকরণের কাজও করা যায় না। বামফ্রন্ট সরকার গোড়া থেকেই এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, সেই কাজকে আরও নিখুঁত করতে হবে, উন্নততর করতে হবে। এটাই আমাদের সামনের চ্যালেঞ্জ।
-কলকাতার গণশক্তি থেকে এই স্বাক্ষাৎকারটি সংগ্রহ করে পাঠিয়েছেন আমাদের ত্রিপুরা প্রতিনিধি দেবতোষ চক্রবর্তী
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com