গতবছর করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করার প্রথম দু মাস আমার উপর দিয়ে কি স্ট্রেস গিয়েছে তা বোঝার মতন দ্বিতীয় কেউ নেই। সেসময় আমার হাসপাতালে করোনায় ডিউটিরত স্বাস্থ্যকর্মীরা টানা ছয় থেকে দশদিন হাসপাতালে ডিউটি করে। এরপর তাদের দশদিনের আইসোলেশন। অন্যদিক আমি সপ্তাহে পাঁচদিন আসি। এভাবে রেডজোনে সমস্ত স্টাফদের মধ্যে আমিই সর্বাধিকবার পা ফেলেছি। সপ্তাহে একদিন জাপানিজ টিমের সাথে বৈঠক হয়। টানা কয়েক ঘন্টা ধরে সবাই মিলে কথা বলি কর্তৃপক্ষের সাথে। প্রতিটি পেপার নিয়ে জবাবদিহি করতে হয়। দিনশেষে কনসালটেন্ট, মেডিক্যাল অফিসার, নার্সিং স্টাফ সবার কাজের এবং ভুলের দায় বর্তায় আমার উপর। অবশ্য এই সময়ের মধ্যেই আমার প্রতি আস্থা অর্জন করার অনুকুল পরিবেশও তৈরী হয়ে যায় দিনে দিনে।
পরিবারের মধ্যে অনেকে আক্রান্ত হয়েছিলো করোনায়। বন্ধুমহলের কেউ নিজে, কেউ বা আত্মীয় পরিজনের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যোগাযোগ করেছে।ফেসবুকে যারা ঘনিষ্ট তাদেরকেও যতটা সম্ভব পরামর্শ দিয়েছি। সব ছাপিয়ে যে বিষয় আমাকে সবচাইতে বেশি মানসিক সংকটে রেখেছে সে হচ্ছে আমার একমাত্র মামার অসুস্থতা। চিকিৎসা নিয়ে নয়, মামার ম্যানেজমেন্ট নিয়েই অনেক বেশি সম্পৃক্ত থেকেছি। গতবছর ক্যান্সার ধরা পড়ার শুরুতে হিমোগ্লোবিন কম ছিলো। এমতাবস্থায় যেকোনো মুহুর্তে হার্ট ফেইলর হওয়ার ঝুঁকি ছিলো। সেকারণে মামীকেও জানতে দিইনি আসল ডায়াগনোসিস। যখন তাকে খানিক সুস্থ করা গেছে তখন সকলে জেনেছে। মামার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়ার দুমাস পরে অন্যরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনেছে।
উদ্বিগ্ন সেই দিনগুলোর মধ্যেই বিদেশ থেকে কানে আসে আমার মেয়ে কাব্যের জ্বর আসার খবর। ডাক্তার পরিবারের সবচাইতে বড় অসহায়ত্ব এই যে তাদের মুশকিলে অন্যদের সাপোর্ট তারা কমই পায়। আমার বর বছর কয়েক আগে টাইফয়েডে দুইমাস শয্যাশায়ী ছিলো। হলফ করে বলছি একজন ব্যক্তির কাছ থেকেও সামান্য সহযোগিতা পাইনি। আমার মেয়ে যখন অসুস্থ হয় তখন আমি দিশা হারাই। চব্বিশ ঘন্টা তার সাথে নেটে থেকে পরামর্শ দিই। বমি, মাথাব্যথা আর গায়ে ব্যথা থাকায় সতর্ক করেছি। যখন জানতে পারি, তার করোনা হয়নি তখন আমি কিছুটা আস্বস্ত হই। কিন্তু তারপরও স্ট্রেস আমার পিছু ছাড়েনি। আল্লাহ মানুষের একমাত্র সহায় মানি বলেই হয়তোবা সেসময় নিজেকে স্থির রাখতে পেরেছি।
আমার মা বাবা উত্তরাতেই নয় নম্বর সেক্টরে বসবাস করছিলেন । আমার একমাত্র ভাই মুন্না, ভাইয়ের পতœী লিজা আর বাচ্চা নিয়ে পাঁচজনের সংসারে একজন বৃদ্ধা মহিলা সাহায্যকারী হিসেবে আছেন বহুবছর যাবত। একয়জনেই তাদের সংসার। সেসময় আম্মা আব্বাকে নিয়ে করোনার দুঃসময়ে উৎকন্ঠার মধ্যে থেকেছি। দুজনের মধ্যে আব্বা বেশি নাজুক কারণ তার বয়স আশি অতিক্রম করেছে। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় আব্বা কাতর।আম্মা সত্তুর প্লাস। আব্বাকে দেখাশোনা করেন আম্মা নিজে। অথচ আম্মার শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। তাকে সুস্থ করে তোলার সংগ্রামে আমি তাই ব্যতিব্যস্ত থেকেছি। সেপ্টেম্বরের শুরুতে একদিন সকাল থেকে পাঁচবার বমি হবার পর আমি গিয়ে স্যালাইন পুশ করেছি। উদ্দেশ্য শরীরে লবনের ঘাটতি না হতে দেয়া। সেদিনের মতন আম্মাকে কিছুটা সুস্থ করা সম্ভব হয়েছিল স্যালাইন দিয়ে। পরের সপ্তাহে পেট জুড়ে প্রচন্ড ব্যথা ছিলো আম্মার। কনস্টিপেশন আর বমিভাব। এ্যাভোলাকে পেট নরম হলো। দীর্ঘদিন ধরে যে এ্যান্টি হরমোন ঔষধ খান, সেটির ডোজ কমালাম।সমস্ত লক্ষ্মণ এই ঔষধের সাইড ইফেক্ট বলে মনে হচ্ছিলো। সাথে যোগ করলাম এ্যান্টি-ইমেটিক (বমিরোধক)। গুগল থেকে ঔষধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আম্মাকে পড়ে শুনিয়ে আস্বস্ত করেছি। পেট ব্যথা কমলেও হাটুর ব্যথার কারণে আম্মাকে প্যারাসিটামল খেতে বলে দিয়েছি। কিন্তু দুদিন থেকে জ্বর আসতেছে শরীরে। একশ এক বা দুই হচ্ছে। আমার টেনশন শুরু হয় স্বাভাবিকভাবেই।ঠান্ডা,গলাব্যথা, মাথাব্যথা, গায়ে ব্যথা নাই। রুচি আছে, খাচ্ছেন ঠিকমতোন। শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক। কোন কমপ্লেন নাই। আম্মাকে আইসোলেট করলে আব্বা অসহায় হয়ে পড়বেন। আবার দুজন মিলে জ্বরে আক্রান্ত হলে আমরা অসহায়।
করোনা আর ডেংগুর প্রয়োজনীয় টেস্ট করাবার কথা ভাবছিলাম নিরুপায় হয়েই। কিছুতেই অন্যসব পরীক্ষার জন্য আম্মাকে বাইরে বের করতে নারাজ আমি।এক্ষেত্রে আমার যুক্তি হলো টেস্ট করানোর জন্য ঘর থেকে বাইরে নিয়ে ফলস্বরূপ করোনাকে শরীরে বয়ে নিয়ে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আর চিকিৎসার যাবতীয় আয়োজন তো আমি ঘরে রেখেই এনশিউর করতে পারছিলাম। তাহলে এই দুঃসময়ে কেন এতো রিস্ক নেবো?সব মিলিয়ে আমি সিদ্ধান্তহীনতায় সময় কাটাচ্ছিলাম । চেষ্টা করেছি নিয়মিত আম্মাকে সাপোর্ট দিতে।
এদিকে মামা জুন থেকে তিন মাস ধরে লড়াই করেছেন ক্যান্সারের সাথে। সাথে যোগ হয়েছে উপসর্গবিহীন কোভিড পজিটিভ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা। অন্যদের লক্ষ্ণন থাকলেও মামার কিছুই সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু একমাস সময় অতিক্রম করলেও রিপোর্ট নেগেটিভ হয়নি। ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য এ্যান্টিবডি তৈরি করছে না শরীর। সেজন্য রেডিওথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারার অপারগতা মেনে নিতে হচ্ছে সকলকেই।
লেখক-ডাঃ নিবেদিতা নার্গিস
এফ.সি.পি.এস,এম.ডি
সহযোগী অধ্যাপক এবং হেড অফ ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট
জাপান ইস্ট ওয়েস্ট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল
আইচি নগর, উত্তরা, ঢাকা।
আখাউড়ানিউজ.কমে প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, ভিডিও চিত্র, কপিরাইট আইন অনুযায়ী পূর্বানুমতি ছাড়া কোথাও ব্যবহার করা যাবে না।
Development by: webnewsdesign.com